
একটা গল্প বলি
আরাফাত হোসেনের ফোন এলেই গল্পকার আরিফ চৌধুরী তার গুরুত্ব বোঝেন। আরাফাত ভাই ফোন করেন বছরে পাঁচবার। তিন মাস পর-পর তার পত্রিকায় গল্প পাঠানোর তাগাদা দিতে। আরেকবার রোজার মাস শুরু হবার আগে তার সাথে যোগাযোগ হয়। ঈদ সংখ্যার জন্যে। ফোন ধরলেই জানতে চান, ‘গল্প তৈরি তো?’ আরিফ জানেন। নতুন লেখা থাকলে পাঠিয়ে দেন। এখন হাতে কোনো গল্প নেই। গল্পের অনেকগুলো ধারণা আছে, লেখা হয়নি; বসা হয়নি। ফোন আসতেই, আরিফ বলেন, ‘আরাফাত ভাই, গেল এক মাস কিছু লেখা হয়নি।’
‘আরিফ ভাই, এসব বললে হবে? আপনি হচ্ছেন একটা চাকা; গড়াতে শুরু করলে প্রতি মুহূর্তেই গড়াতে হবে। যান, এক্ষণ লিখতে বসেন, আমার মঙ্গলবার লেখা লাগবে, বুধবার মেইক-আপ এবং ছাপা।’
‘আচ্ছা’।
‘আচ্ছা মানে? আপনি না বললেন বেশ কিছু আইডিয়া আছে; কয়েকটা আইডিয়ার গল্প আমারে শোনান; শুনে দেখি ভাল লাগে নাকি।’
আরিফ চৌধুরী বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম এবার একটা দুঃখের গল্প দেব আপনাকে।’
‘বলেন দেখি’।
আরিফ গল্পটি বলেন।
‘যশোরে একটি প্রতিষ্ঠান অবহেলিত মায়েদের জন্যে ফল উৎসবের আয়োজন করেছে। ষাটোর্ধ মায়েরা যাদের সন্তানেরা তাদের ফেলে চলে গেছে, এই প্রতিষ্ঠান মাসে একদিন তাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসে। তারা পেট পুরে এবং মন ভরে খাওয়া-দাওয়া করে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের জন্যে দোয়া করেন। এবার তারা আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল নিয়ে এসেছে। আরাফাত ভাই, মাসের বাকি ঊনত্রিশ দিন এই মায়েরা কেমন করে বাঁচেন আমি তা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারি। কী বলেন?’
‘এইটা কি গল্প হইলো নাকি? এইটা তো আর্টিকেল লেখার বিষয়। অবশ্য আপনি হাত দিলে ঠিকই গল্প বানিয়ে ফেলবেন; তবে সমাজের উঁচু যায়গায় আঘাত করা চলবে না। আপনার মধ্যে তো আবার সর্বহারা-সর্বহারা একটা ভাব আছে; আপনারে নিয়ে অনেক সমস্যা। কেমনে যে আপনি এতো ফেমাস হইলেন। সবাই ক্যান যে আপনার লেখা পড়ে, আমি বুজি না’।
‘আরাফাত ভাই, আপনার পত্রিকা তো উচ্চবিত্তরা পড়ে না; তারা শিরোনাম দেখে তাদের নিয়ে কিছু থাকলে অনলাইনে শেয়ার করে। পত্রিকা বিত্তহীনরাই কেনে; পড়ে।’
আরিফ চৌধুরী আরেকটি প্লটের কথা বলেন।
‘কল্পনা করুন, কাবুলের নীল গম্বুজওয়ালা মসজিদের সামনে বাজার জমেছে। পচা কমলার বস্তা সাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে। পাশেই নান রুটির উচ্ছিষ্ট অংশ গবাদিপশুকে খাওয়ানোর জন্য কেনা হয়। এখন ক্ষুধার কারণে মানুষেরা কিনছেন বাসি এসব খাবার। একই সাথে মসজিদের ভেতর ইমাম সাহেব সহজে পুলসেরাৎ পার হবার উপায় বাতলে দিচ্ছেন। অনেক উপায় থাকতে পারে, আরাফাত ভাই। আমি উপায়গুলো কল্পনা করতে পারি। পাঠকরা অনেক খাবে। পাঠকদের একটা বড় অংশ শেষ বিচারের দিন নিয়ে অনেক চিন্তিত। এই লেখা তাদের জন্যে।’
আরাফাত হোসেন ক্ষেপে যান। ‘আপনি আমারে মারতে চান নাকি আরিফ ভাই? নিজেও কোপ খাবেন। এইসব কী চিন্তা করেন আপনি?’
আরিফ আরাফাতকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
‘আরে আরাফাত ভাই, ক্ষেপেন কেন? আচ্ছা, আরেকটা আইডিয়া দিই। ধরেন এক স্বৈরশাসক দেশের পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিদের সাথে কথা বলছে। তার নামে কবিতা লিখে দিতে বলছে। ভাল গল্প হতে পারে। আপনার পাঠক পছন্দ করবেন।’
‘আরিফ ভাই, আপনি একটা চরম ধুরন্ধর লেখক।’
আরিফ জোরে হাসে। বলেন- ‘ধুরন্ধর না হলে লেখক হওয়া যায় না, আরাফাত ভাই; প্রকাশককে তার চেয়ে বড় ধুরন্ধর হতে হয়। আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?’
‘ক্যান আপনার ভয় করে না? কোপ তো দু’জনেই খাবো। আপনার পাখি শিকারের গল্পটি বেশ ভাল লেগেছিল। আইনি হত্যা কেমন হতে পারে তা বেশ সুন্দর করে বলেছেন কিন্তু আপনাকে কেউ কিছু বলেনি। মনে হয় ওরা পড়ে বোঝেনি। আর কী আছে বলেন?’ আরাফাত জানতে চান, ‘আপনার সাথে কথা বলতে বেশ ভালই লাগে; আপনার কল্পনাশক্তি আমাকে নাড়া দেয়।’
আরিফ উত্তরে বলেন, ‘আপনি ফোন করলে আমারও খুব ভাল লাগে; আর কারও সাথে এই আকাশ-কুসুম চিন্তা নিয়ে আলাপ করতে পারি না’
আরিফ বলেন, ‘আরাফাত ভাই- ধরেন, এক বন-গবেষক তার গবেষণা চালাতে গিয়ে কোনো না কোনোভাবে মশাদের ভাষা বুঝতে শুরু করলেন; তিনি এতই আগ্রহী হয়ে উঠলেন যে, বন নিয়ে গবেষণা ছেড়ে তিনি সারাদিন মশাদের আলাপচারীটা শোনেন। একদিন দেখলেন বনের ভেতর তাদের মশাদের এক বিশাল সভা বসেছে। সভার উদ্দেশ্য মানুষদের আক্রমণ করা…’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান। আগে বলেন বনে মানুষ এলো কোত্থেকে? মশাগুলোইবা কেমন করে বনে বাস করে?!’
‘কী বলেন আরাফাত ভাই! মানুষ বনগুলোকে আস্ত রেখেছে নাকি? সব বনেই মানুষ আছে; আর মানুষ থাকলেই মশা থাকতেই হবে।’
‘আচ্ছা; ঠিক আছে, কিন্তু মশারা মানুষদের মারতে চাইবে কেন?’ আরাফাত জানতে চান।
আরিফ বলেন- ‘মশারা মনে করছে মানুষ আর পৃথিবী চালাতে পারছে না, তাই মানুষকে নির্মূল করতে চায়।’
‘কিন্তু মশা ক্যান? অন্য প্রাণি দিলে হয় না?’
‘আরাফাত ভাই- মশারাই মানুষের সবচেয়ে কাছে থাকে। মানুষের ভাল বৈশিষ্ট্যও জানে, খারাপও জানে। মাছিও আমাদের কাছেই থাকে, তবে মশাদের মতো নয়। ধরেন মশা না দিয়ে গরু বা মোষ দিলাম; এরা তো আমাদের শুধুই নৃশংস জীব মনে করে; আমাদের শুধু খারাপ দিকটাই চেনে।’
‘শেষ করবেন কেমন করে?’
‘এখনও ঠিক করিনি; লিখতে লিখতে যেখানে গিয়ে শেষ হয়।’
আরাফাত একটু ভাবেন। বলেন- ‘মনে হচ্ছে সবার মাথার ওপর দিয়ে যাবে, আরিফ ভাই। আপনি বরং একটা সর্বহারা টাইপের কিছু লেখেন।’
‘কিন্তু আপনিই না বললেন পাখি শিকারের গল্প আপনার ভাল লেগেছে!’
‘নাহ, এটাতে মন টানছে না’।
‘তাহলে আমাদের দেশের চা বাগানের শ্রমিকদের কষ্ট নিয়ে লিখতে পারি। গল্পে প্রেমও থাকবে; বাগানের এক ম্যানেজারের সাথে এক নারী কর্মীর প্রেম হবে। ম্যানেজারের পরিবার বসবাস করে ঢাকা শহরে। এটা নিয়ে এক জম্পেশ গল্প হতে পারে। বাংলাদেশের পাঠক অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে গল্প ভালবাসে; তারা নিজেরাও অসহায়, তাই পছন্দ করে।’
‘খবদ্দার! চা কোম্পানির একটা বিজ্ঞাপনও আর আসবে না; এখন দুইটা পেয়েছি সারা বছরের জন্যে।’
‘তাহলে, আরাফাত ভাই, হিরো কালামের প্রেমের গল্প লিখে দিই; এই সময়ে এর চেয়ে ভাল গল্প আর হতে পারে না; হিরো আমাকে নিয়ে আদালতে যাবে না কারণ সে নিজেই…’
কথা বলতে বলতে আরিফের কাছে আরেকটি ফোন আসে। কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখেন শাহানা ফোন করেছে। শাহানা আরিফের স্ত্রী- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আরাফাতের সাথে আইডিয়াটা বলে শেষ করতে পারেন না আরিফ। বলেন, ‘আরাফাত ভাই- আমি আপনাকে এক মিনিট পর আবার কল করছি।’
আরাফাতের ফোন কেটে দিয়ে শাহানার কথা শোনেন আরিফ। আরিফ হা-হুতাশ করার মানুষ নন, তবে শাহানার ফোন তাকে স্তব্ধ করে দেয়। তাদের মেয়ে ডেইজীকে তার স্বামী নূর মারধোর করে আহত করেছে। বেশ রক্তারক্তি ঘটনা। ডেইজীকে হাসপাতালে নিয়েছে নূর নিজেই। আরিফ শুধু বলেন, ‘তুমি থাকো ওর কাছে, শাহানা; আমি আসছি।’
শাহানার ফোন রেখে, কম্পিত হাতে আরিফ আবার ফোন করেন আরাফাতকে। ‘আরাফাত ভাই, আমার মেয়ের একটু শরীর খারাপ করেছে। আমি ওর কাছে যাচ্ছি; ফিরে আবার আপনার সাথে কথা বলবো।’
বাইরে যাওয়ার কাপড় পরে, দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে আরিফ ভাবেন, ‘আমি গল্প লেখা নিয়ে এ কী সব ভাবছি?! আসল গল্পটিই তো আমার লেখা হয়নি।
প্রথম প্রকাশ – দৈনিক সংবাদ
বেশ নাটকীয় গল্পটা। ভালো। মশার অংশ বেশি ভাল