ক্যাডেট জীবনের ইতিকথাঃ ক্যাম্পাসের ছেলে

ঐ যে বলেছিলাম! মনে আছে? মা ভোর বেলা দাঁড়িয়ে থাকতেন নামহীন সেই খালের ওপারে আমায় এক নজর দেখার জন্যে? আমি পিটির সময় দৌড়ে খালের এপার দিয়ে যাবো, তাঁর দিকে তাকাবো। শুধু ও’টুকু তাকিয়ে দেখে তিনি কি যে সুখ পেতেন তা বোঝার ক্ষমতা বোধহয় এ জীবনে হবে না। আরেক জীবনেও হয়তো হবে না। মা না হলে এসব বোঝা যায় না। তবে আমি বোধহয় কিছু-কিছু বুঝতাম। অন্য কাডেটরা বা আমার বন্ধুরা মনে করতেন, আহারে ইকরাম কি ভাগ্যবান। একদিন পরপরই মাকে দেখতে পাচ্ছে; বাবাকে দেখছে প্রতিদিন।

ওঁদের বাবা-মা অনেক-অনেক দূরে, চোখে দেখা যেতো না। ওঁরা যা বুঝতে পারতেন না তা হচ্ছে খালের এপার থেকে ওপারে মাকে এক ঝলক দেখা ওঁদের মা দূরে থাকার চেয়েও আরও অনেক বেশি দূর। যখন মনে হয়, এইতো আছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে, কিন্তু ছুঁতে গেলেই আরও দূরে চলে যায়; সেই দূরত্ব বিশ্বের আর সব দূরত্বের চেয়েও বেশি দূর তা ওঁদের বোঝাতে পারতাম না।

জেসিসির এই ক্যাম্পাসের ছেলেগুলোর ক্যাডেট জীবন ছিল এমনই। বাবা-মা কাছে থেকেও নেই; মনে হয় তাঁদের ধরা যাবে, কিন্তু যেতো না। বাবাকে হয়তো প্রায়ই দেখা যেত তাঁর কর্মস্থলে কর্মরত। বাবা হয়তো দেখেও দেখতেন না; ছেলের দিকে তাকালে যদি কোন দোষ হয়! কর্তৃপক্ষ যদি তাঁকে পক্ষপাত দোষে দোষী ভাবেন! বাবা পেশাগত স্থানে অটল থাকতেন বা থাকতে পারতেন। কিন্তু মায়ের পক্ষে ঐ একটু উঁকি-ঝুকি দিয়ে দেখে যে তার মন ভরতো না তা ক্লাস সেভেন থেকেই কিছু-কিছু বুঝতাম। শনিবার সিনেমা-সন্ধ্যায় মিলনায়তনে ঢোঁকার দরজার মুখ থেকে একটু দূরে দু’বোনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন কিসের আশায়, তাও কিছু-কিছু বুঝতাম। কিন্তু করার ছিল না কিছুই; কে যেন বলে দিতো, ‘এ’দূরত্বই তোমার জীবনের সবচেয়ে অমোঘ সত্য; এ’নিয়েই বেঁচে থাক’।

এ’ভাবেই কেটে যায় দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর…তাঁরা যদি খুলনায়, বা যশোরে, বা ঢাকায় থাকতেন, বুঝে নিতাম, তাঁদের দেখবো তিন মাস পর।

ঝিনাইদাহ ক্যাডেট কলেজের ক্যাম্পাসের কথা কিছুটা বলে নেয়া জরুরী। এই ক্যাম্পাসের শিক্ষক-কর্মচারীদের ছেলেদের [এবং মেয়েদের] সবারই দাদা- ও নানাবাড়ি ছিল, কিন্তু তাদের কেউ’ই নানাবাড়ি ও দাদাবাড়িকে নিজের বাড়ি বলে মনে করতো না। যেথায় জন্ম, সেথায় তাদের বাড়ি; যেথায় শিশুকাল, সেথায় তাদের বাড়ি।

ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন অনেক বন্ধু ও ছোট ভাইদের কাছ থেকে শুনেছি যে তাদের বাবা-মা বেশ জোর করেই ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে বলেছিলেন এবং তা পাস দিলে কলেজে চলে যেতে বলেছিলেন। আমার মত এই ক্যাম্পাসের ছেলেগুলোর পরিস্থিতি কিন্তু তা ছিল না। শিশুকালে ভোর বেলা আমাদের ঘুম ভাঙ্গতো ক্যাডেটদের প্যারেড গ্রাউন্ডের ব্যান্ড-পার্টীর ড্রামের শব্দে। আমাদের সকাল কাটতো ক্যাডেটদের মত একাডেমিক ব্লকে মার্চ করে গিয়ে ক্লাস করার স্বপ্নে। আমাদের বিকেল কাটতো ক্যাডেটদের মত করে বাস্কেটবল, ফুটবল ইত্যাদি ও ক্রীড়া-কৌশল রপ্ত করার আকাঙ্ক্ষায়। আমরা তখন ঘুনাক্ষরেও ভাবি নি বাবা-মা ছেড়ে চলে গিয়ে ক্যাডেট হলে কেমন কষ্ট সহ্য করতে হতে পারে।

বুঝেছিলাম অনেক পরের…ক্যাডেট হওয়ার পর…

ক্যাম্পাসের ছেলেদের আরও অনেক কষ্ট ছিল। সবাই মনে করতো যে ক্যাম্পাসের ছেলে হিসেবে, শিক্ষক-কর্মচারীর ছেলে হিসেবে তারা কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় এমনি-এমনি পাস করে গেছে; কিছু না পারলেও তাদের ক্যাডেট হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। কলেজ-জীবন শুরু করার পর, বড়ভাই, বন্ধু, ছোটভাই – সবাই এ বিষয়টি হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

কষ্ট পেয়েছি জেনে যে তারা ভেবেছিলেন আমরা পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তি হই নি। এমনি-এমনি হয়েছিলাম।

তবে ওসব কষ্ট এখন মনে নেই; মনে আছে শুধু যে বাড়িতে থাকতাম, সেই বাড়িটা, যে হাউসে থাকতাম সেই হাউসটা, যে ক্লাসে বসতাম সেই ক্লাসটা; যে মাঠে খেলতাম, সেই মাঠটা…

5 Replies to “ক্যাডেট জীবনের ইতিকথাঃ ক্যাম্পাসের ছেলে”

  1. Wonderful write up dear Munna bhai, i have also the same feeling like you as I was in MCC…. Anu, son of Mr Rezaul Islam.

  2. একরাম, অতি সুন্দর লেখা। পড়ে প্রচুর আনন্দ পেলাম এবং সেই সাথে কলেজ জীবনের ফেলে আসা অনেক স্মৃতির কথা মনে কিরিয়ে দিলো।

    1. মনে করিয়ে দিয়েছে যে স্মৃতি তা এখন লিখে রাখা উচিত যেন আমাদেরমত পাঠকেরা তা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারে। আশা করি লিখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *