Photo: Collected

ক্যাডেট জীবনের ইতিকথাঃ পৃথিবীতে এক আশ্চর্য স্থান আছে

এমন ভোরে কাকও ডাকে না। জোনাকিরা তখনও হয়তো ঘুমুতে যায় না। তারপরও ভোর সোয়া ৫টায় হাউস ডিউটি-ক্যাডেটের বাঁশির শব্দে রবীন তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে। সে কখনই ঘুম থেকে উঠতে গড়িমসি করে না। তাকে ডেকে তোলার জন্য কারও প্রয়োজন পড়ে না। তবে কলেজ ডিউটি-ক্যাডেটের ঘণ্টা সে কস্মিনকালেও শুনতে পায় না। শুনলে সেই ঘণ্টার সঙ্গেই চোখ মেলত। এ ক্যাম্পাসে ঘুমিয়ে থাকতে তার ইচ্ছে করে না। সব সময় মনে হয়, এ কলেজে ঘুমিয়ে থাকা মানেই সময়ের অপচয়। কত কিছু করার আছে! ঘুমুলেই তো সময় হারিয়ে যাবে।
রবীনরা একাদশ শ্রেণিতে। ম্যাট্রিক পাস দিয়ে ফিরে এসেছে ছয় মাস হয়। এই পাস করে কলেজে যারা ফিরে আসে, তাদের আচরণ থাকে যুদ্ধ জয়ের পর মায়ের কাছে ফেরার মতো। মাথায় থাকে বাবড়ি চুল। ব্যাগ কাঁধে কলেজের ফটক দিয়ে হেঁটে নিজ নিজ হাউসের দিকে যখন এগিয়ে যাবে, তখন হয়তো অন্য সব ক্যাডেট খেলার মাঠে। একজন করে বাবড়িওয়ালা যাবে, আর সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখবে। অমন বাবড়ি চুল এ কলেজের সব ক্যাডেটেরই প্রার্থনা। মনে মনে সবাই ভাবে, ‘যেদিন এখান থেকে বের হব, তারপর সারাজীবন আর চুল কাটাব না।’
গত সন্ধ্যা থেকে রবীনের মনে একটাই চিন্তা। হাউস বেয়ারা তারাদা গোল্ড ফ্লেইক সিগারেট দিয়ে গেছেন। এমন সিগারেট জীবনে রবীনরা কেউ কখনও টানেনি। গোল্ড ফ্লেইক! প্যাকেটটা অনেক রঙচঙে। ফিল্টার আছে! স্টারের মতো নয়। এই তারাদাকে কেউ যদি ধরতে পারে যে তিনি ক্যাডেটদের সিগারেট পৌঁছে দিয়েছেন, নির্ঘাত তার চাকরিটি যাবে। চাকরির ভয় না করেও তিনি রবীনদের উপশহর থেকে সিগারেট কিনে এনে দেন। এমন অনেক রবীনকে তিনি অতীতেও সিগারেট এনে দিয়েছেন। হয়তো ভবিষ্যতেও দেবেন।
গোল্ড ফ্লেইক তো পাওয়া গেল। কিন্তু তারাদা তো দেশলাই দিয়ে যাননি। জ্বালাবে কী করে। ডাইনিং হলে সকালের নাশতা তৈরি করার জন্য অনেক রাত অবধি আগুন জ্বলে। সেখান থেকে অনেকবার আগুন এনেছে তারা, কিন্তু প্রতিবার সেখান থেকে আনা বেশ বিপজ্জনক।
সকালের পিটি শেষে, খাঁকি ড্রেস পরে, ব্রেকফাস্ট সেরে, সবার সঙ্গে মার্চ করে কলেজ ব্লকে গিয়ে প্রথমেই রুটিন দেখে রবীন। আজ তার কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের প্রয়োজন। সোডিয়াম লাগবে গোল্ড ফ্লেইকে আগুন ধরাতে। ল্যাবের জারগুলোতে থরে থরে সোডিয়ামের টুকরো কেরোসিনের ভেতর চুবিয়ে রাখা। কেরোসিন থেকে বাইরে বের করলেই সোডিয়ামের টুকরোগুলোয় আগুল জ্বলে উঠবে। রবীন চাইছেও তাই। হাউসের হারিকেন থেকে খালি কাশির ওষুধের বোতল পকেটে নিয়ে এসেছে সে। খাতার কাগজ লম্বা করে ভাঁজ করে কেরোসিনে ভিজিয়ে জ্বলতে থাকা সোডিয়ামের গায়ে ধরলেই হয়ে যাবে তাদের দেশলাই।
অদৃষ্ট প্রসন্ন। কাশির ওষুধের বোতলে করে সোডিয়ামের টুকরো হাউসে এনে নিশ্চিন্তে লাঞ্চ করতে চলে গেল রবীন। তার আগে সব হাউসের বন্ধুদের জানিয়ে দিল, তারা আজ নতুন ধরনের সিগারেট টানবে। সবাই যেন সময়মতো নীল হাউসের দোতলার কমনরুমে চলে আসে। লাল ও সবুজ হাউসের বন্ধুরা সময়মতো চলে এলো। এসে দেখল, রবীন কয়েকজন বড় ভাইকেও সিগারেট টানতে নেমন্তন করেছে। প্রায় সবাই প্রেফেক্ট। মুস্তাফিজ ভাই সবুজ হাউসের, ফয়সাল ভাই গেমস প্রেফেক্ট, এজাজ ভাই নিজের হাউসের প্রেফেক্ট। লোকে বলে, রবীনকে সিগারেট টানা শিখিয়েছিলেন এজাজ ভাই।
রবীন ও তার বন্ধুরা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিল সপ্তম শ্রেণিতে। প্রথম যেদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে বারো বছরের শিশুরা এই কলেজের গণ্ডিতে ঢোকে, সেদিন এখানে ছিল সাজসাজ রব। প্রিন্সিপাল, অ্যাডজুট্যান্ট ও শিক্ষকরা সবাই তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাদের আগমন উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিসপ্লে। এই ডিসপ্লেগুলো চলতি ঘটনাবলি নিয়ে প্রায় নাটক দেখানোর মতো। পাঁচ-ছয়জন মিলে উপস্থাপনা করে আর নানা ধরনের মডেল বানিয়ে, ছবি এঁকে সবাইকে চলচ্চিত্রের মতো একটি আবহ দেওয়ার চেষ্টা করে। মনোমুগ্ধকর। হোয়াইট ড্রেস পরে মঞ্চে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়ানো ক্যাডেটদের কী যে স্মার্ট লাগে! ক্যাডেট কলেজে ভর্তির উচ্ছ্বাসে এই ডিসপ্লে দেখে রবীনের খুবই ভালো লেগেছিল।
একসময় অনুষ্ঠানের কলরব স্তিমিত হয়। সময় আসে বাবা-মাকে বিদায় জানানোর। ছোট এই ছেলেগুলো জানে না, তারা কী হারাতে যাচ্ছে। বাবা-মা অশ্রুসজল নয়নে ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দেন। পিতামাতাও জানেন না, তারা কোন পৃথিবীতে সন্তানদের ছেড়ে যাচ্ছেন। শুধু জানেন, এখানে পড়াশোনা করলে তাদের সন্তান মানুষের মতো মানুষ হবে; অনেক বড় হবে। সন্তানরাও থাকে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে। ক্যাডেট কলেজ কী, তা কারও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। ওরা জানে, সবাই ক্যাডেট কলেজে পড়তে এসেছে। বাবা-মাকে বিদায় দিতে অনেকেরই মন বিমর্ষ হয়; অনেকেই কাঁদে, আবার অনেকে বাবা-মাকে শান্ত হতে বলে।
বিদায়পর্ব শেষে প্রায় ৫০ জন ক্যাডেটকে তাদের জন্য নির্ধারিত হাউসগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে থাকেন অষ্টম শ্রেণির বড় ভাইরা। এরা সবাই নতুনদের লকার-পার্টনার বা গাইড। এ কলেজের নিয়মকানুন, আইন-শৃঙ্খলা সব এই বড় ভাইরা শেখাবেন। আজ থেকে ছয় মাস পরে নভিসেস প্যারেড হবে। তখন লকার-পার্টনারদের দায়িত্ব পূর্ণ হবে। সেদিন থেকে সপ্তম শ্রেণির নতুন ছেলেরা সত্যিকারের ক্যাডেট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই ছয় মাসের মধ্যেই সবাই বুঝে যায়, এদের মধ্যে কে পড়াশোনায় ভালো, কে খেলাধুলায় ভালো, কে দুটোতেই ভালো। তবে এই প্যারেড শেষ হওয়া পর্যন্ত এরা কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে যায়। কথায় কথায় শাস্তি; এখানে শাস্তিগুলো আসলে প্রশিক্ষণ। বাবা-মা যদি এই শাস্তিগুলোর কথা জানতেন, তাহলে কখনই তাদের ছেলেদের এই কলেজে ছেড়ে আসতেন না।
রবীন কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যায়, এখানে বাবা-মাহীন জীবন চালাতে হলে এখানকার আনন্দগুলো আবিস্কার করতে হবে, খেলাধুলা-দুষ্টুমিতে মেতে থাকতে হবে। পড়ালেখায় মাঝামাঝি একটা অবস্থান থাকলেই যথেষ্ট। শুধু শিক্ষকদের রোষানলে না পড়লেই হলো। বড় ভাইদের রোষানল কাউকে খারাপ ক্যাডেট হিসেবে পরিচিতি দেয় না; কিন্তু একবার যদি কোনো স্যার কাউকে ‘খারাপ’ বলেন, তাহলে তার পুরো ছয় বছর খারাপ ক্যাডেট হয়েই কাটাতে হবে। শত চেষ্টা করেও আর ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। রবীন আরও অনেকের মতো চারদিক বুঝে চলা শিখে গেল। কোনোমতে পড়াশোনা চালিয়ে গেল; মনোযোগ দিল খেলায়, আর ক্যাডেটীয় আনন্দে।
কলেজে হাজারও নিয়ম; নিয়ম ব্যত্যয় ঘটলেই শাস্তি- শাস্তি দেন অ্যাডজুট্যান্ট, শিক্ষকরা, হাবিলদাররা এবং বড় ভাইরা। এবং ক্যাডেটরা ওই নিয়মটাই ভাঙতে চায়। নিয়ম ভাঙায় কী যে আনন্দ! খেলাধুলা করা, সপ্তাহে একটি সিনেমা দেখা, নিউজউইক বা টাইম ম্যাগাজিন পড়া, লাইব্রেরিতে গিয়ে গল্পের বই পড়া- এ ছাড়া তো আর কোনো আনন্দ নেই। তাই এই ছেলেরা আনন্দ আবিস্কার করে। পিটি-প্যারেড ফাঁকি দেওয়া, অসুস্থ না হলেও সিক্‌ রিপোর্ট করা, রাতবিরাতে কলেজের নারিকেল গাছ ও আম গাছ থেকে আম-ডাব পেড়ে সবাই মিলে খাওয়া, পাঁচিল টপকে বাইরে গিয়ে খেজুরের রস চুরি করে এনে সবাইকে খাওয়ানো, লুকিয়ে উপশহরের সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আসা- এসব নিয়ম ভঙ্গ করে কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা না পড়া তাদের সবচেয়ে বড় আনন্দ। ছেলেরা ভাবে, ‘আসলে এগুলো আনন্দ নয়, এগুলো সব একেকটি জানালা।’ এই জানালাগুলো দিয়েই তারা এই ক্যাডেট-দ্বীপে বসে বিশ্ব দেখতে পায়।
খেলাধুলার পাশাপাশি রবীনের কবিতা লিখতে মন চায়, ‘কলেজ আলেখ্য’ সম্পাদনা করতে মন চায়, দেয়াল পত্রিকায় গল্প লিখতে মন চায়, বার্ষিক নাটক প্রতিযোগিতায় অভিনয় করতে মন চায়, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সব মেডেল জিতে নিতে মন চায়। সে জানে, সবকিছু সে একা নিতে পারবে না। তার কলেজ প্রতিযোগিতায় পরিপূর্ণ; জিততে হলে দল তৈরি করতে হবে; যে যা ভালো পারে, সে কাজ তাকে দিয়েই করাতে হবে। রবীন সব খেলাই ভালো খেলতে পারে, কিন্তু সে বেছে নিয়েছে বাস্কেটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, ডিসকাস, শটপাট আর জ্যাভলিন থ্রো। অন্য সবাইকে উদবুদ্ধ করতে তার জুড়ি নেই। তার সংস্পর্শে এলে যারা খেলতে পারে না, তাদেরও খেলতে মন চায়। তার চালচলন এক ধরনের নেতাদের মতো। ছোটরা সবাই আশা করে, রবীন ভাই একদিন কলেজ গেমস প্রেফেক্ট হবেন। বন্ধুরাও তাই বিশ্বাস করে। কলেজের হাবিলদাররা আশা করে, এখান থেকে পাস দিয়ে সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে- অনেক বড় অফিসার হবে। সে নিজে অবশ্য কোনো রকমের প্রেফেক্ট হতে চায় না; দায়িত্ব পেলেই সে একা হয়ে যাবে, সবার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে, সবাইকে শাসন করতে হবে। এ কলেজে এত বছর শাসিত হওয়ার পর সে নিজে কাউকে শাসন করতে চায় না।
রবীনরা যখন দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠল, তাদের বন্ধুরা কলেজের অধিনায়কের দায়িত্ব নিল। সবচেয়ে উঁচু শ্রেণির ক্যাডেটদের টানা সাত দিনের শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ কলেজের ক্যাডেটরা যায় সুন্দরবন দেখতে। যাত্রা শুরু হয়েছিল এক গ্রীষ্ফ্মের সকালে। তেপ্পান্নজন ক্যাডেটের সঙ্গে ভাইস প্রিন্সিপাল, অ্যাডজুট্যান্ট ও দু’জন শিক্ষক। সেদিন অবশ্য বৃষ্টি বা কোনো ঝড়-বাদল ছিল না। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেল মোংলা বন্দরে। এক রাত মোংলায় থেকে পরদিন সকালে বার্জে করে রওনা দিল হিরণ পয়েন্টের দিকে। সেখানে যেতে প্রায় সারাদিন লেগে গেল। হিরন পয়েন্টে গিয়ে সবাই উঠল এক রেস্টহাউসে। সেখানে প্রকাণ্ড এক হলরুমে তেপ্পান্নজনের একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থা হলো। সারারাত ক্যাসেট প্লেয়ার চালিয়ে নাচ-গান আর মোংলা থেকে কেনা বিদেশি সিগারেট ফুঁকে সময় কাটিয়ে দিল। রাতে রেস্টহাউসের চারদিকে হাজার হাজার ছোট ছোট নীলাভ আলো জ্বলজ্বল করতে দেখে প্রথমে কেউ বোঝেনি; ওখানকার গার্ডদের কাছে জানতে চাইলেই তারা জানালেন, ওগুলো সব হরিণ। রাতের বেলা রেস্টহাউসের চারপাশে ভিড় করে। রাতে ওদের চোখ জ্বলজ্বল করে।
সময়টা খুব সাধারণভাবেই কাটছিল। অঘটন ঘটল পরদিন সকালে। ভাইস প্রিন্সিপাল, অ্যাডজুট্যান্ট এবং দু’জন স্যার একটি ট্রলারে করে পশুর নদ ভ্রমণে বেরোলেন। অত্যন্ত খরস্রোতা। স্রোত গিয়ে পড়েছে একেবারে সাগরে। প্রায় আধঘণ্টা স্রোতের দিকে গিয়ে তারা ফিরছিলেন রেস্টহাউসের জেটির দিকে। দূরে দেখা গেল ছোট্ট একটি ডিঙি ছিপ নৌকায় বৈঠা মেরে চারজন খাঁকি পোশাক পরা মানুষ স্রোতের দিকে আসছে। রবীনও ছিল ট্রলারে। সবাই বুঝে গেল, ওই চারজন ক্যাডেট। ওরা খুব সহজেই স্রোতের পক্ষে আসতে পারছে, কিন্তু যখন ফিরতে চাইবে এমন স্রোতের বিপরীতে বৈঠা চালানো ওদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ওরাও ট্রলারটি দূর থেকে চিনে ফেলল। ট্রলারে অ্যাডজুট্যান্ট আছেন, তা বুঝে তাড়াহুড়ো করে নৌকা তীরে ভিড়িয়ে কোনোমতে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে বনের ভেতর দৌড়ে হারিয়ে গেল। অ্যাডজুট্যান্ট ট্রলার সেখানে ভেড়াতে আদেশ করলেন। কূলে পানিস্বল্পতায় একেবারে কাছে যাওয়া গেল না।
রবীনসহ যারা সঙ্গে ছিল, তাদের নির্দেশ দিলেন ওদের ডাকতে। ট্রলারের কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চলতা লক্ষ্য করা গেল। তারা নদীতীরের নরম কাদায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখিয়ে বিপদ হতে পারে, তা নিশ্চিত করলেন। এবং এ কথা শুনেই অ্যাডজুট্যান্টের ভয় হলো। তিনি আরও জোরে ওদের ডাকতে থাকলেন। অনেক ডাকাডাকির পর চারজন বেরিয়ে এলো গাছগাছালির ভেতর থেকে। এদিকে রবীনরা সমূহ বিপদ ঠাহর করে ট্রলারের ডকে যত রকমের লাঠি ছিল, তা আস্তে আস্তে কুড়িয়ে পাটাতনে ঢুকিয়ে দিল। যেন অ্যাডজুট্যান্ট ওদের লাঠিপেটা করার জন্য হাতের কাছে কোনো লাঠি না পান। লাঠিপেটা করার মতই অকাজ তারা করেছে।
ওদের তুলে নিয়ে ট্রলার পৌঁছে যায় জেটিতে। নেমে অ্যাডজুট্যান্ট বলেন যে তিনি আজই এই শিক্ষা সফরের সমাপ্তি ঘোষণা করছেন। এমন বেয়াড়াপনা করলে শিক্ষা সফর হবে না। রবীনরা তাদের ক্লাসের অধিনায়কদের তার কাছে পাঠাল মন নরম করার জন্য। তার মন গলে না। শেষে অ্যাডজুট্যান্ট রবীন ও তার প্রিয় বন্ধু তাওসিফকে ডেকে পাঠালেন। ওরা গিয়ে তার সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল। স্যার কথা না বাড়িয়ে ওদের আদেশ দিলেন, ‘আমি তোমাদের দু’জনকে দায়িত্ব দিলাম তোমাদের বন্ধুদের সামলে রাখতে। আর একটি ঘটনা ঘটেছে কি আমি সবাইকে নিয়ে তখনই কলেজে ফিরে যাব। আমি জানি, তোমাদের কথা সবাই শুনবে।’
ইতস্তত করল দু’জন। বলল, ‘স্যার প্রেফেক্টরা তো আছে! আমরা!’
‘হ্যাঁ, তোমরাই। ওরা পারবে না; তোমরা পারবে। যাও ওদের ঠেকিয়ে রাখো।’ অ্যাডজুট্যান্ট স্যারের আদেশ শুনে এ দু’জন দুষ্টু ক্যাডেটের মন নেচে উঠল। নিজেদের সত্যিকারের নেতা মনে হলো। প্রেফেক্ট হয়নি তো কী হয়েছে? প্রেফেক্ট হওয়ার জন্য বাকি জীবনটা তো পড়েই রয়েছে।
এ কলেজের সবাইকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভালো অফিসার হওয়ার উপযুক্ত করার জন্য। রবীনের সে ইচ্ছাও নেই। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে চায়। তার মতো এমন অনেক ছেলে আছে, যারা সেনা হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। একটি খতিয়ান নিলে দেখা যাবে যে প্রতি ব্যাচেই প্রায় অর্ধেকের বেশি ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ না দিয়ে দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষায় চলে যায়। সবাই-ই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক ভালো করে। ক্যাডেট থাকা অবস্থায় এদের সবার জীবনের গল্প এক রকম, কিন্তু কলেজ থেকে বেরোনোর পর একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম। অনেক ছেলে বিদেশে পড়তে গিয়ে আর ফেরে না, অনেকে সরকারি চাকরিতে চলে যায়, অনেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে জীবনযাপন করে, করপোরেট চাকরিতে গিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যায়, অনেকে সেনাবাহিনীতে গিয়ে অফিসার হয়। শুধু একটি ক্ষেত্রে রবীনদের দেখা যায় না- জাতীয় রাজনীতি। হাতে গোনা দু-একজনকে রাজনীতির মাঠে দেখা গেছে, তবে খুব যে সার্থক হয়েছে, তা বলা যাবে না।
রবীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্যাডেট কলেজের অনেক অভ্যাস ত্যাগ করে। যে পড়াশোনা সে কখনও নিবিড়ভাবে করেনি, তা করতে সচেষ্ট হয়। একই সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও অংশ নেয়। টের পায় যে কলেজের দুষ্টুমিগুলো তার এই জীবনে বেশ সাহায্য করছে। প্রায়ই বুদ্ধি দেয় আন্দোলনকারীদের। তখন অনেকের হাতে মারণাস্ত্র। সে অস্ত্র হাতে নেয় না। অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেলেও সে যে ফল আশা করছিল, তা পেয়ে যায়। প্রথম হয়। চেষ্টা করে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির জন্য। বেশ ক’বার চেষ্টার পর পেয়েও যায়। চলে যায় দেশ ছেড়ে। লেখাপড়া শেষ করে আস্তানা গাড়ে আমেরিকার লুইজিয়ানায়। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি অসাধারণ সুন্দর। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। নিজ দেশের মানুষ যত বিপদাপদে, ঝড়-ঝঞ্ছায় দিনানিপাত করে, সেসব তাকে ছোঁয় না। ভালোবেসে সংসার পাতে এক আমেরিকানের সঙ্গে। বুঝে যায়, তার আর জীবনে দেশে এসে বসবাস করা হবে না। তবে ভালোই আছে সে। দেশের বিত্তশালীদের চেয়েও ভালো আছে।
প্রতিবছরই বাবা-মা, ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করতে আসে রবীন। যে বছর আসতে পারে না, বাবা-মাকে কিছুদিনের জন্য সেখানে নিয়ে যায়। দেশে এলেই ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের নিয়ে যায় সেই ফেলে আসা কলেজে। দু-তিন দিন সেখানে থাকে। চেষ্টা করে এ দু-তিন দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে। কলেজে পা ফেলেই মনে হয়, এই ক্যাম্পাসের মতো পৃথিবীতে আর একটিও স্থান নেই। তার বাবা-মায়ের বাড়ির চেয়েও প্রিয় এ কলেজ। এখান থেকেই তার ও তাদের জীবনের শুরু। রয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা নির্মূল করে ফিরে যেতে হয় সাধারণ জীবনযাপনে। চলে যেতে যেতে, বারবার ফিরে তাকায় কলেজের দিকে। টের পায় কতটা ভালোবাসে এ কলেজকে। ভাবে, এক জীবন একে ভালোবাসার জন্য অপ্রতুল, তাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে এ স্থানকে মন ভরে ভালোবাসতে।

[এ অভিজ্ঞতা সত্তরের দশকের শেষ এবং আশির দশকের প্রথমের। তখন মেয়েদের ক্যাডেট কলেজের জন্ম হয়েছে মাত্র। তাই মেয়েদের কলেজের অভিজ্ঞতার খতিয়ান এখানে দেওয়া গেল না। ওহ, হ্যা; সব চরিত্রের নামগুলো বদলে দেয়া হয়েছে এ লেখায়।]

প্রথম প্রকাশঃ কালের খেয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *