
খোদার চাউনি
গেল বার আগুনের পর কয়দিন কাটিয়েছিল আপার বাড়ির নিচে পার্কিংয়ে। গভীর রাতে গিয়ে ছেলেমেয়েসহ ঘুমিয়েছিল। সকাল হওয়ার আগেই আবার এখানে ফিরে এসেছে। আপার মন অনেক বড়ো। অনেক দয়া। গেল বার তার স্বামীর কাছ থেকে দশ হাজার টাকা চেয়ে নিয়ে আফরোজাকে দিয়েছিল। আবার রাতে এসে তাদের পার্কিংয়ে রাতে থাকতেও বলেছিল। আরো বেশি বেতনের কাজ পেলেও আপার বাড়ি ছেড়ে সে যায় না। আপার বাড়ি থেকে লুকিয়ে কিছু নিয়ে আসারও প্রয়োজন হয় না। চাইলেই তিনি কিছু না কিছু দেন। খাবার, টাকা, ওষুধ, নতুন কাপড়, ছেলেমেয়ের বইপত্র।
এ তল্লাটে বৃষ্টি আসার কোনো সময়-অসময় নেই। মাঝে মাঝে শীতেও বাদল ঝরে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা নেই। আসমানে জলের বুদ্বুদগুলো ভাসতে ভাসতে দলবেঁধে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার সময় নিজেদের ভার যখন বইতে পারে না, তখন ঝমঝমিয়ে মাটির পানে ছুটে আসে। দাবড়ে আসে। ধনুছেঁড়া তীরের মতো মর্ত্যে আছড়ে পড়ে, মাটি ভেদ করতে চায়। মাটির ওপর মানুষগুলোর শরীর, তাদের ঘরবাড়িও ভেদ করে চলে যেতে চায়। এ এমনই বাদল যা মানুষকে ঘরছাড়া করে ছাড়ে। আর একবার ঘরছাড়া হলে নতুন করে ঘর বাঁধা মহাশক্তিধর মানুষের পক্ষেও অসম্ভব হতে পারে। বাদলের আঘাত যে কতটা মর্মভেদী হতে পারে, তা যে সয়েছে সেই বোঝে।
তেমনই এক আকাশ উজাড়করা ঢলের মতো ঝুম-ঝাপসা বৃষ্টির মাঝে নীলের ওপর ফুল-ফুল একটি পলিথিনের চাদর মাথায় ও পিঠের ওপর জড়িয়ে তার নিচে বসে আছে আফরোজা। আশপাশে পড়ে থাকা কয়েকটি বাঁশের কাবারি কুড়িয়ে মাটিতে গেড়ে আরেকটি পলিথিনের চাদর একটি সামিয়ানার মতো টাঙিয়েছে মেয়ে রূপসা ও ছেলে লিটনের জন্য। নিজে ভেজে ভিজুক, সন্তানেরা যেন এমন বাদলে না ভেজে। জ্বরে পড়বে বাচ্চাগুলো। ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই। অসুস্থ হলে সে যার বাসায় কাজ করে সেই আপা প্রায়ই ডাক্তার দেখানোর জন্য কয়েক শ টাকা দেন। এনজিওর ডাক্তাররাও আজকাল বিনে পয়সায় ওষুধ দেয় না। তবে পলিথিনের অভাব নেই এ বস্তিতে। শহরের দশ প্রান্তে যে যেমন পারে পলিথিন ছড়িয়ে রাখে। শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা বস্তিবাসীরা তা কুড়িয়ে এনে, সেলাই করে মাথার ওপর ছাউনি তৈরি করবে বলে ভাঁজ করে রেখে দেয়। একেবারে চাদরের মতো। এমন বাদল দিনে পলিথিনের এই চাদরগুলো খুব কাজে আসে।
শুধু বৃষ্টি নয়, বাতাসও বইছে। বৃষ্টির গায়ে বাতাস ঝামটা মারছে। জল ও বাতাস একাকার। আরেকটু বেশি হলেই মোটা-মোটা মার্বেলের বলের মতো দেখাবে। দৃষ্টিহীন বৃষ্টি। তারই মাঝে কেমন যেন একটি চেহারা ভেসে উঠছে। এমন ঘন বৃষ্টির মাঝে চেহারা! কার চেহারা? কে যেন তার পানে তাকিয়ে রয়েছে। তার সন্তানদের পানেও। যেন চাউনির রশ্মি টের পাচ্ছে সে। সে চাউনিতে কোনো পলক নেই। দেখছে তো দেখছেই। চেহারাটির একবার চোখ বড়ো হচ্ছে; একবার হা বড়ো হচ্ছে। পলিথিনে ঢাকা-মোড়া আফরোজা সেই দৃষ্টির পানে থেকে থেকেই তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে দৃষ্টিটি তাদের গৃহহীনতা উপভোগ করছে কি না। রূপসা আর লিটনের দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। কখন তারা আবার ছাউনি ছেড়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। বৃষ্টি ভেদ করা দৃষ্টিকে তার খোদার চাউনি মনে হয়। স্বয়ং আল্লাহ তাকে ঘরছাড়া করে বৃষ্টির জলে ভর করে এসে তার কষ্ট দেখছেন আর ভাবছেন—‘দেখি বান্দা কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারে’।
খোদা প্রায়ই এমন করেন। প্রতিবারই আফরোজা এই চাউনি দেখতে পায়। কখনো বাতাসে, কখনো বৃষ্টিতে আবার কখনো তার বস্তিঘরের চিতায়। এবার আর আগুনের হলকার মাঝে খোদার চোখ দেখেনি; দেখেছে দু দিন পর বৃষ্টির ঝাপটানির মধ্যে।
দু দিন আগেও এই বৃষ্টির কোনো নাম-গন্ধ ছিল না। তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। চ্যাট্-চ্যাট্ শব্দে একটার পর একটা বস্তিঘর পুড়ে যাচ্ছিল। পোড়ার শব্দ এক অদ্ভুত শব্দ। আর কোনোকিছুর সাথে মেলে না। আফরোজা অনেক সিনেমায় আগুন ধরার ছবি দেখেছে, শব্দও শুনেছে। সিনেমাওয়ালারা ঠিক করে শব্দ শোনাতে পারেনি; একেবারেই নয়। আফরোজাদের বস্তিতে যখন আগুন লাগে, তখন সিনেমাওয়ালারা থাকে না। তারা থাকলে আসল শব্দ রেকর্ড করে সিনেমায় আগুনের ছবির সাথে জুড়ে দিতে পারত।
ছোটবেলায় দেখেছিল বাপজানের ধানে একবার আগুন লেগেছিল ফরিদপুরের কামারপাড়া গ্রামে। তার বাবা কামার ছিলেন না। দাদা ছিলেন। কোনো এক কালে ওদের গ্রামের প্রায় সব সংসারেই একজন করে কামার ছিল। বাবা বলতেন, সেই সেন রাজাদের আমলে গ্রামের নাম দেওয়া হয়েছিল; পরে কেউ আর বদলানোর কথা ভাবেনি। এখনো রয়ে গেছে। আফরোজার বাবা ছিলেন কৃষক। কামার মহী বিশ্বাস কামারের কাজ করে কিছু জমি কিনতে পেরেছিলেন। জমির উত্তরাধিকারী ছিল তার সন্তান খোদাভীরু সগীর বিশ্বাস। আধাক্রোশ দূরে ভিটে থেকে বেরিয়ে রাত-ভোরে মেয়ে-বউকে সঙ্গে নিয়ে, দু হাত দিয়ে দুজনকে কাস্তে ধরার মতো চেপে ধরে দূরে দাঁড়িয়ে সগীর বিশ্বাস ‘আল্লাহ আল্লাহ’ জপেছিলেন। ধানে আগুন ধরলে করার কিছু থাকে না। আফরোজার এখনো মনে আছে, কেমন করে চিড়-চিড় শব্দ তুলে আগুন সমস্ত ধানের মাঠ খেয়ে ফেলেছিল। আগুনেরও যে শব্দ আছে তা সে তখনই জেনেছিল। ছোট্ট আফরোজা টের পেয়েছিল সেদিন। এখন আরো বেশি টের পায়; এখন সে বোঝে ঘরপোড়া শব্দ আর ধানপোড়া শব্দে তফাত থাকলেও এই দুই শব্দের ধ্বংসলীলা একইরকম। কয়দিন আগে পুরান শহরে কেমিক্যালের গুদাম থেকে আগুন ধরে এক আটতলা বাড়ির সবাই পুড়ে মারা গেছে বলে ফরিদ মোল্লার দোকানের টেলিভিশনে দেখেছে সে। কী কাণ্ড! কেমিক্যালের আগুন যে পলিথিনের আগুনের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে তা সে এখন বোঝে। কেমিক্যালের আগুনে ঘর ভেঙে-ভেঙে পড়ে, পলিথিনের আগুন সবকিছু গলিয়ে দেয়। তাদের বস্তিতে যেদিকে চোখ যায়, শুধু পলিথিন আর পলিথিন। সাথে লেপটে থাকা চাটাই-টিনও গলে যায়।
চোখের সামনে এতগুলো ঘর মাটিতে গলে যেতে দেখে সে তার সন্তানদের আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দূরে দাঁড়িয়ে শুধুই সেই ‘আল্লাহ আল্লাহ’ই জপেছে আর আল্লাহর চাউনির খোঁজ করেছে। দেখেছেও। অন্তত মনে হয়েছে যে সে দেখেছে। বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়েও দেখেছে। চোখ বুঁজলেও দেখতে পেয়েছে।
সরকার কতবার বলেছিল এ শহরে কাঁচা বস্তি আর থাকবে না। সব পাকা হবে। দশতলা হবে গরিবের বস্তি। লিফট থাকবে। আগুনের ভয় আর থাকবে না, বাদলে ভেজার ভয় থাকবে না। প্রায় কুড়ি বছর ধরে আফরোজা সরকারের এই প্রতিজ্ঞা হজম করে আসছে। হয়তো আর শুনতে ইচ্ছে করে না, তবে এ প্রতিজ্ঞা যে আরো অনেক বছর শুনতে হবে তা আফরোজা জানে। যতদিন এ শহরে বাস করবে, ততদিন।
যতবার এ বস্তিতে সে আগুন সয়েছে, তার সবই শুরু হয়েছে ভোর রাতের কিছু আগে। যখন বস্তিবাসী অঘোরে ঘুমিয়ে। খোদার চোখ বোধহয় ঘুমন্ত মানুষের পানে চায় না। ঘুমন্ত মানুষ বোধহয় পাপ করতে পারে না, তাই তিনি তাকান না। ঘুমুতেই তিনটা বাজে তো ভাঙবে কী করে। লতা, ঝুমা, বুলবুলি—ওরা তো সারারাতেও ফেরে না। খদ্দের ছুটি দিলে তবেই না ফিরবে। সারারাত উপুর্যপরি খদ্দের থাকে। রিক্সাওয়ালা খয়ের, বদর, শামীম—ওরাও ওদের সাথে খদ্দের-এলাকায় ঘুরে বেড়ায় আর ভোরে ফিরে আসে। মেয়েগুলোকে রিক্সায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর পুলিশের খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে দেয়। এসে সারাদিন ঘুমায়।
এবারও চট্ করে কারো ঘুম ভাঙেনি যে তরা করে আগুন নেভাবে। আর ভাঙলেই বা কী? হাতের কাছে জলই বা কোথায়? পাশেই খাল আছে, তবে কেউ ঘুমুতে যাওয়ার আগে হাতের কাছে জল নিয়ে শোয় না। আগুন যখন ঘরের ভেতর ছোবল মারে তখন ঘুম ভাঙে। এক কলস জল হয়তোবা কাছে থাকে। ঐ এক কলসে কিইবা হয়। এবারে প্রায় দু’শ ঘর পুড়েছে। এমনই হয়। প্রতিবারেই এই দু’শই পোড়ে। খোদা যেন দু’শই পছন্দ করেন। আর প্রতিবার তার ঘরই পুড়তে হয়। পোড়ার পর কেউ গোনে না, তবে বোঝা যায়।
গেল বার আগুনের পর কয়দিন কাটিয়েছিল আপার বাড়ির নিচে পার্কিংয়ে। গভীর রাতে গিয়ে ছেলেমেয়েসহ ঘুমিয়েছিল। সকাল হওয়ার আগেই আবার এখানে ফিরে এসেছে। আপার মন অনেক বড়ো। অনেক দয়া। গেল বার তার হাজব্যান্ডের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা চেয়ে নিয়ে আফরোজাকে দিয়েছিল। আবার রাতে এসে তাদের পার্কিংয়ে রাতে থাকতেও বলেছিল। আরো বেশি বেতনের কাজ পেলেও আপার বাড়ি ছেড়ে সে যায় না। আপার বাড়ি থেকে লুকিয়ে কিছু নিয়ে আসারও প্রয়োজন হয় না। চাইলেই তিনি কিছু না কিছু দেন। খাবার, টাকা, ওষুধ, নতুন কাপড়, ছেলেমেয়ের বইপত্র।
তার বাড়ি বেশি দূরেও নয়। খালের ওপারেই। নৌকা দিয়ে যেতে হয়। প্রতি পারাপারে অবশ্য পাঁচ-পাঁচ দশ টাকা চলে যায়। মাসে তিন’শ। পরে একসময় আপার কাছে চাইলেই দিয়ে দেয়। তাই পারাপারের খরচ গায়ে লাগে না।
আজও আপার বাড়িতেই যেতে হবে। আর কোনো উপায় নেই। এখানে রাত কাটানোর পরিস্থিতি নেই। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর আকাশ থেকে ঢল এল। সেই ঢলে চারপাশে সব কাদায় চটকে গেছে। এই কাদা রাতেও শুকাবে না। আর শুকালেও বা কী? ঘুমুতে তো পারবে না। কেউই। আগেরবার আগুনের পর বৃষ্টি হয়নি। কাদাও জমেনি। তাই ঘরপোড়া মানুষ মাটিতেই শুয়ে কিছুরাত কাটাতে পেরেছিল। এবার সবাই কী করবে কে জানে! আফরোজা প্রাণপণ দোয়া করে চলেছে বৃষ্টিটা যেন থামে। কিছুটা থেমেও এসেছে। তবে আজ রোদ্দুর আসবে না বলেই এখন মনে হচ্ছে। বৃষ্টিটা থামলেই সে রূপসা-লিটনকে নিয়ে আপার বাড়ি রওয়ানা দেবে। তবে বৃষ্টি কখন কমবে তা বোঝা যাচ্ছে না। সেও কতক্ষণ পলিথিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে তা-ও বুঝতে পারছে না। রূপসা-লিটনকে জলে ভিজতে দেওয়া যাবে না। খিদেও পেয়েছে। নিজের কিছু না জুটলেও হবে, ছেলে-মেয়েদের আগে খাওয়াতে হবে। আপার বাড়িতে যেতেই হবে। এতক্ষণে হয়তো তিনিও আগুনের খবর পেয়ে গেছেন। তার বাড়ির ছাদ থেকে এ বস্তি দেখা যায়, আগুনও দেখা যায়। রাতের আগুন। হয়তো দেখেননি।
আজ আপার বাড়িতে যেতে পারেনি আফরোজা। আগুনের খবর তাকে জানাতেও পারেনি। মোবাইল ফোনটাও পুড়ে গেছে। জানাবে কেমন করে? অসুখ-বিসুখে আপাকে সে সকাল সকালই জানিয়ে দেয় যে কাজে আসা আজ আর সম্ভব হবে না। আপা কিছু মনে করেন না; সেদিন চালিয়ে নেন।
আজ বৃষ্টিটা কমলেই তার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেবে আফরোজা।
একসময় কমেও যায়। থামে। মাটি পুড়েছে, চাটাই পুড়েছে, পলিথিন পুড়েছে। চারদিকে পোড়া গন্ধ। পৃথিবীতে প্রথম আগুন কবে ধরেছিল আফরোজা ভাবতে চেষ্টা করে। পারে না। তার জানা নেই। সে শুনেছে ফেরেস্তারা আগুনের তৈরি। বোধহয় কোনো এক ফেরেস্তা এসে আগুনের শরীর নিয়ে পৃথিবীর মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।
রূপসা-লিটনকে বলে, ‘ওই তরা আয়, চল ওপার যাই। আইজ রাইতে আফার বাড়িত থাকুম। ল যাই, রতন মাজি আহেনাই দেহি। পার অইতে অইবো।’
মাঝিরা নেই। আজ পারাপার হবে না। ওদেরও ঘর পুড়েছে। ওরাও এ বস্তিরই মানুষ। এখানেই বসবাস। এখন ঘরপোড়া মানুষ। হয়তো কাছেই আছে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক ঘুরে যেতে হবে। তাইই সিদ্ধান্ত নেয় আফরোজা। একেবারে শূন্য হাত। কিছুই বাঁচাতে পারেনি। আধঘণ্টা ছেলেমেয়েকে নিয়ে হেঁটে আপার বাড়ির গলিতে ঢোকে। খিদেয় পেটের ভেতর ব্যথা করছে। আপার কাছে গিয়ে কিছু খাবার চেয়ে খাবে।
গলিতে ঢুকে পঞ্চাশ গজ গেলেই আপার বাড়ি। ঢুকেই ঠায় দাঁড়িয়ে যায় আফরোজা। অন্তত একশ মানুষ বাড়ির সামনে ভিড় করে আছে। পুলিশ, মাথায় লাল কাপড় বাঁধা প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন মানুষ ও অফিসার গোছের কিছু মানুষ। পুলিশের গাড়ি কয়েকটি, সাথে বড়ো এক বুলডোজার। প্রথমে তার চিন্তা হোঁচট খেলেও পরক্ষণে বুঝে যায় এরা বাড়ি ভাঙতে এসেছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে আরো নিশ্চিত হয়—হ্যাঁ, এ বাড়িই ভাঙবে। না ভাঙলেও ভাঙার ভয় দেখাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে আপা আছেন কি না দেখার চেষ্টা করে। তাকে দেখতে পায় না। ভিড় ঠেলে ওপরে যাওয়ার চেষ্টা করলে কয়েকজন বাধা দেয়। আফরোজা তাদের বুঝিয়ে রূপসা-লিটনকে নিয়ে তিন তলায় আপার ফ্ল্যাটে আসে। দরজা খোলাই ছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে বুঝে যায়—আপারা গোছগাছ করছেন। এখান থেকে চলে যাবেন বলে মনে হচ্ছে। রূপসা আর লিটনকে দাঁড়াতে বলে সে আপার ঘরের দিকে যায়। আপা সেখানে। আপার সাথে চোখাচোখি হয়। তিনি ঘর্মাক্ত। তাকে দেখে আপা বলেন, ‘আফরোজা এসেছো? আমি তোমাদের আগুনের কথা শুনেছি। তোমারটা এবারও পুড়েছে?’
সে মাথা নেড়ে সায় দেয়।
‘কী আর করবে! আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। পেছনের কথা সব ভুলে যেতে হবে। দেখছো না, আমাদেরকেও এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। আজ থেকে আমরাও ঘরহীন।’
আফরোজা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে।
আপা বলেন, ‘বুঝতে পারছো না? অন্য আরেকজনের জমিতে আমাদের ডেভেলপার এই বাড়ি বানিয়ে আমাদের কাছে বিক্রি করেছিল, আমরা জানতাম না। শহর উন্নয়ন সংস্থা তাই আমাদের এখান থেকে বের করে দিচ্ছে। বাড়িও ভেঙে ফেলবে বলছে। এখন কোথায় যাব জানি না। তুমি এসেছো ভালোই হয়েছে; আমাদের একটু গোছাতে সাহায্য কর।’
‘জ্বী, আপা।’
এ কথা বলেই সে বারান্দায় যায়। গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে। খোদার চোখ খোঁজার চেষ্টা করে। খোদা তাকিয়ে আছেন কি না বোঝার চেষ্টা করে।
প্রথম প্রকাশঃ ইত্তেফাক সাময়িকী ২০১৯