
দার্শনিক হুমায়ূন
ঠিক করেছি হুমায়ূনকে আর লেখক বা গল্পকার মনে করবো না। তাঁকে একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হিসেবেই ভাবতেই ভাল লাগছে। বাংলাদেশে দার্শনিক নেই, সবাই কথা বলায় ব্যস্ত। কথা যারা বেশি বলেন, তারা বেশি লেখন না। আমার মনে হয় হুমায়ূনের লেখা ছিল তাঁর দর্শন প্রকাশের এক মাধ্যম মাত্র।
যাই হোক, এই বই দর্শনে পরিপূর্ণ।
গল্পের সারাংশ বলিঃ
<<হিমুর খালা তার বিয়ে ঠিক করেছেন, পাত্রীর নাম রেণু। সে হেরোইন-আসক্ত এক ছেলেকে ভালবেসে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল – তাই তাড়াহুড়ো করে হিমুর সাথে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। হিমু শুনেই রাজি হয়ে যায় এবং সারাদিন অনেক ঘটনা-প্রাচুর্যের মধ্যেও সে নিজেকে বিয়ের পাত্র বলে পাঠকদের কাছে তুলে ধরে। তবে তার আসল ইচ্ছে আমরা পরে বুঝবো। রেণুর বাবা আমেরিকান, মা বাঙ্গালী। তার মা-বাবার সাথে হিমুর খালা-খালুর বন্ধুত্ব আছে। রেণুর পছন্দের ছেলের নাম তুর্য। তুর্যকে খালার বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। হিমু তার খালুর গাড়ি নিয়ে খালুকে না বলে বেরিয়ে যায়। পচা বাবার কাছ থেকে হেরোইন কিনে হাজতে গিয়ে তুর্যকে দিয়ে আসে। তবে তুর্য হেরোইনের নেশা ছেড়ে দেয়। রেণুর বাবা ফার্গুসানকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসার সময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়। ফার্গুসানের সাথে তুর্যর পরিচয় হয়। রেণুর বাবা তুর্যকে পছন্দ করেন। শেষে তুর্যের সাথে রেণুর বিয়ে হয়। হিমু বসে থাকে থানায়। সাথে ছিল ড্রাইভার মকবুল ও ক্ষুর আসলাম।>>
অনেকে বলেন হুমায়ূন হিমুর মাঝে তাঁর নিজের হিমু-মনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। হতে পারে। হিমু চরিত্রকে তিনি অনেক রকম ভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর দর্শন-প্রকাশের অস্ত্র হিসেবে।
এক – তিনি হিমু নামের এই বহিরাগতের চিন্তা এবং কাজের মাঝে সমাজ নামের বৃত্তের ভেতরের মানুষগুলোর চরিত্র পাঠকদের দেখাতে চেয়েছেন।
দুই – ডায়ালগ তাঁর আরেকটি বড় অস্ত্র যা অন্যান্য ঔপন্যাসিকরা বর্ননায় তুলে ধরেন।
তিন – গল্প এগিয়ে নিতে যা করার, হিমুকেই করতে হয় এবং তার আশেপাশের মানুষগুলো তারই তৈরি ছাঁচে সেই গল্পে পা দেয়।
এই বইতে বেশ কটি উক্ত হুমায়ূনের দর্শনকে পরিস্কার করেঃ-
১। <<পৃথিবীতে আনন্দ এবং দুঃখ সব সময় থাকবে সমান সমান। বিজ্ঞানের ভাষায় – কনসার্ভেশন অব আনন্দ। একজন কেউ চরম আনন্দ পেলে, অন্য জনকে চরম দুঃখ পেতে হবে।>> এই বইয়ে তার অনেক উদাহরণ আছে।
২। <<তুমি নিজেকে যা মনে করো তুমি তাই। তুমি যদি নিজেকে মহাপুরুষ ভাবো তুমি মহাপুরুষ। আর তুমি যদি নিজেকে পিশাচ ভাবো তুমি পিশাচ।>> হুমায়ূন এখানে ‘ল অব এ্যাট্রাকশন’ প্রয়োগ করেছেন। মানবের চেতন মন হচ্ছে জাহাজের নাবিক এবং অবচেতন মন ইঞ্জিন। নাবিক ইঞ্জিনকে যে নির্দেশ দেবে ইঞ্জিন সেভাবেই চলবে। [[[নাবিক ও ইঞ্জিনের উদাহরণ ইকরামের – হুমায়ূনের নয়]]]
৩। সক্রেটিসের দর্শন নিয়ে উক্তি আছে। মনে রাখতে হবে যে তিনি নিজেকে জানা, চৈতন্যসিক্ত হওয়া, বর্তমানে বসবাস করা – এমন অনেক দর্শন-চিন্তা আমাদের দিয়ে গেছেন। অস্তিত্ববাদীরা বর্তমানে বসবাস করেন এবং এ বিষয়ে হিমুর জুড়ি নেই। সক্রেটিস তাঁর জল্লাদকে বলেছিলেন তিনি মৃত্যুকে অনুভব করতে চান, ঘুমের মাঝে মৃত্যু তিনি চান না। হিমুও হাজতখানাকে অনুভব করতে চায়।
৪। হেরোইন কেনার সময় নব্বই বছর বয়সি পচা বাবার কাছে হিমু জানতে চেয়েছিল তিনি হেরোইনে আসক্ত কিনা। বাবা বলেছিলেন, তিনি আসল ‘মজা’ চান – এসব সামান্য মজা তাকে টানে না। আসল মজা কি? আসল মজা হচ্ছে মৃত্যু।
‘আজ হিমুর বিয়ে’র আরও কয়েকটি চরিত্র হচ্ছেন রেনুর মা, ধানমন্ডি থানার ওসি সোলায়মান, ড্রাইভার মকবুল, ক্ষুর আসলাম। আমাদের দার্শনিক হুমায়ূন কাউকে বাদ দেননি। হিমুর হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত একটা প্রেম-পরিণতির শেষাংশের শুরু।
আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। হুমায়ূনের সাহস আছে বটে। এই গল্পে তিনি আইন-শৃংখলা বাহিনীরও একটা হালকা চরিত্রায়ন করেছেন।
#পড়তে_পড়তে
– ছবি গুগল থেকে নেয়া…