নামহীনতায়

তৈরী হোন। এ এক দানবীয়তার গল্প। পরতে পরতে অমানবিকতায় পরিপূর্ণ। তবে এ আমি আপনার কাছে কেন বলছি জানি না। হয়তো জানতে চাইছেন, তাই। কিই বা লাভ হবে আপনার? শুনেই হয়তো লেখতে বসবেন। আপনাদের পত্রিকার কাটতি বাড়বে। বেশি বিক্রি হবে। আমার পাপের গল্প শুনে আপনাদের পাঠক আরও বেশি করে পত্রিকা পড়বেন। এমন জঘন্য এক চরিত্র এ পৃ্থিবীতে কেন বেঁচে আছে বা থাকে, তা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবেন। বন্ধুদের আড্ডায় আমায় নিয়ে আলোচনা ধুমায়িত হবে। তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে আমার উদাহরণ দিয়ে পাপ থেকে দূরে থাকতে শেখাবেন। তারাও জানবে পাপ কি, সাজা কি, কষ্ট কি। হয়তো আপনার পাঠকদের ও তাদের সন্তানদের জানানোর জন্যই আজ এই গল্প বলা।
আপনার পাঠকদের ছেলেমেয়েদের মত আমার জন্ম নয়। ওদের বাবা-মায়ের সামাজিক মিলন হয়, একান্নবর্তীতা প্রকাশ পায়, মায়ের সাথে বাবার মিলন, মা অন্তঃসত্তা হন, এক অদ্ভূত ব্রক্ষান্ডকে মা নিজের জঠরে খুশি হয়ে স্থান দেন। একদিন সেই ব্রক্ষান্ড ব্যক্তিকারে এই ছোট্ট দুনিয়ায় উগরে আসে। মা তাতেই খুশি, সুখী।
আমিও মায়ের সুখ-খুশ নিয়েই এ পৃ্থিবীতে কিছুটা পথ চলেছি। মায়ের খুশি যেদিন শেষ হতে দেখলাম, সেদিন আমার পতন হল। সেই পতনের কোন শেষ নেই। এমনই পতন যে, পড়তে-পড়তে, এক এক অমোঘ দানবীয়তা আমায় এক অজানা শাপের মত আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে চুরমার করে দিল।
এ’গল্প কিন্তু আপনাদের অনেক পাঠকের জন্যে খুব মুখরোচক হবে।
আমার জন্ম-বৃত্তান্তের ক্ষতিয়ান দিই। জন্মেছিলাম নামহীন এক বাবা’র ঔরসে, যিনি এক নামহীন কর্মে মেতে আমার মায়ের পাতে কয়েক টুকরো পয়সা ছুড়ে দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। সে জানেনি তার সেই কর্ম একদিন আমার জন্ম দেবে। একবারও ভাবেনি সেও একদিন তার নামহীন সন্তানকে না চিনে জীবন কাটিয়ে দেবে, জীবনের শেষ মূহুর্তে আমার মত সন্তানের চেহারা তার চোখে ভাসবে না। হ্যা, জন্মেছিলাম মায়ের গর্ভে, সেই নামহীন বাবা’র বীর্যে। সে আমার কাছে এখনও নামহীন। নামের কি আসলে প্রয়োজন আছে? আমার অবশ্য একটি নাম দেয়া হয়েছিল। পাঠকদের তা বলতে চাই না। আমার ইচ্ছে। আমার ইচ্ছের মূল্য দেবেন না? আমি তো আপনাদের পাঠকদের আকর্ষিত করার জন্যই গল্পটি বলছি। একটু স্বাধীনতা’তো দিতেই হবে।
ভাবছেন এমন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছি কি করে? বলছি। আমার জন্মের প্রায় আট বছর পর এক ইশকুল এলো আমাদের পট্টির কাছেই। মা লেখাপড়া শিখতে পাঠিয়ে দিল। বাংলা পড়ায়, ইংরেজী পড়ায়, অংকও করায়। আরও বড় হলে কিছুটা ভূগোল, ইতিহাস, ইসলামিয়াত। আরবীও জানি কিছুটা। তবে বাংলা আমার ভাল লাগতো। মায়ের কাছে যখন কোন বাবা থাকতো না, সে তখন আমায় গল্প পড়ে শোনাতো।
আমার যখন ছয় বছর, এক বোন জন্ম নিল। সেও এক নামহীন বাবার সন্তান। আমরা কখনও জানতে পারিনি ওর বাবা ও আমার বাবা একই মানুষ কিনা। আমি ওকে খুব ভালবাসতাম, খুব যত্ন নিতাম। মা যখন কাজে থাকতো, আমি সারারাত ওর কাছে থাকতাম, ওকে খাওয়াতাম, ঘুম পাড়াতাম, ওকে কোলের ভেতর রেখে আমিও ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোর হলে মা এসে আমাদের একসাথে নিয়ে গিয়ে তার সাথে শোয়াতো। মায়ের তখন ঘুমের সময়। দু’জনকে জড়িয়ে মা ঘুমে তলিয়ে যেত। আমি ড্যাব-ড্যাব করে কিছুক্ষন মায়ের চেহারা দেখতাম, আমার নামহীন বাবার কথা ভাবতাম, বোনটি কেঁদে উঠলে তাকে আদর করে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিতাম।
কি মনে হচ্ছে? এ গল্প আপনাদের পাঠক পড়বে? পছন্দ করবে? কি বললেন? করবে! তাহলে ভাল। আমিও চাই সবাই এ’গল্প পড়ুক।
আমারদের ইস্কুল বসতো বিকেলে। মা তখন জেগে থাকে। বোনটিকে সেই কাছে রাখে। মায়ের কাছে থাকলে বোঝা যেত না যে আমাদের পাড়ায় এত্তো-এত্তো বাবাহীন সন্তানের বাস। মায়েরা তাদের সন্তানদের আগলে রাখতো। ইস্কুল শেষে খেলা। নামহীনদের আনন্দের মিলন মেলা। নামহীন মেয়েরাও মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতো আর গল্প করতো। খেলাশেষে একসাথে পট্টিতে ফেরা। তখন আমাদের আরেক কাজ শুরু হত। ইস্কুলের বাড়ির কাজ আর করা হত না। মায়ের কাছে যেই বাবারা আসে তাদের বিড়ি-সিগারেট, পান-মদ, কোক-ফান্টা, কাবাব-পরাটা আনতেই সময় চলে যেত। তারপর আমরা এক সময় ঘুমিয়ে যেতাম; কখনও খেতাম, কখনও নয়।
কি মনে হয়? আমাদের জীবন কেমন ছিল? আপনাদের পাঠক খুব আগ্রহ পাবেন। এমন গল্প এ’দেশে আর কেউ ছাপেনি। আপনারাই প্রথম।
মা আবার মা হতে চললো। তখন আমার বয়স চৌদ্দ। ঐ বয়সই ছিল আমার সবচেয়ে দুর্বিষহ সময়। মা আরেকজন নামহীন সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। ঠান্ডা দেহ ধরে বসে ছিলাম অনেক্ষন। কারণ এমন নামহীন নারীকে সমাহিত করার মানুষ ও স্থান পাওয়া যাচ্ছিল না। মা আমায় কোন ধর্মের কথা কখনও বলেনি। তার কোন ধর্ম ছিল কিনা আমি আজব্দি জানি না। জেনেই বা কি হত? ধার্মিকেরা হয়তো আমাদের ধর্মচর্চা করতেও দিত না। এইযে ধরুন, মায়ের দেহ নিয়ে কি করা হবে কেউ বুঝতে পারেনি। পোড়াবে? না গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলবে? সিদ্ধান্ত নেয়া বা দেয়ার কেউ ছিল না। থাকবে কি করে? আমাদের পট্টিতে তো কোন পুরোহিত, মৌলভী বা ফাদারের গোচরে আনাগোনা ছিল না। এ পাড়া দিনে ঘুমোতো, রাতে জেগে থাকতো। অনেক ধর্মের মানুষই এ পাড়ায় আসতো, তবে ধর্ম-বেশে নয়, ধর্মকর্ম ভুলে। আমি জানতে পারিনি মায়ের দেহ নিয়ে মুরুব্বিরা শেষে কি করলেন। জলে ভাসালেন, পুড়িয়ে ফেললেন না পুঁতে ফেললেন – জানি না। তখন মনে হয়েছিল, মা দেহের কাজ করত; তার দেহ মূল্যবান; এতো মানুষ তার দেহকে ব্যবহার করেছে; সেই দেহটাকে যত্নের সাথে বিদায় দিতে হবে। তা হয়েছিল কিনা আমি জানি না।
যাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা ঠান্ডা হয়ে গেল, তার খবরও আমার জানা নেই। কেউ আমায় বলেনি। মনে হয় সে মায়ের দেহ থেকে বের হতেই পারেনি। চিন্তা করুন – কি করুণ পরিস্থিতি! একটি মানুষ যার দেহে প্রাণ এসে গেছে, সে মায়ের পেট থকে বেরোতে পারলো না? কি কষ্টেই না তার দম ফুরিয়ে গিয়েছিল! ওখানে এমন কত নামহীনের দম ফুরিয়ে যেত! শিশুকালে বুঝতাম না; ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে-উঠতে জেনেছি, এ পাড়া দম ফুরিয়ে যাবার পাড়া।
বলেছিলাম না বয়সটি আমার জন্যে দুর্বিষহ ছিল? ভাবতে শিখেছি, সমাজ বুঝি, নিজের জীবনাবস্থান টের পাই। মাঝে-মাঝে শহরের অন্য পাড়ায় যেতে ইচ্ছে করতো। মা’ও বলতেন ঘুরে আসতে। সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করতো। মা অনেকবার টিকেটের টাকা দিয়েছিল। অজানা এক সংকোচে যাইনি। মনে হয়েছে, সিনেমা-দেখনেওয়ালারা সবাই আমাদের চেয়ে উন্নততর, ভিন্ন। এমন উন্নততর মানুষের মাঝে গেলেই অষাড় হয়ে পড়তাম, যা বুদ্ধি-চেতনা ছিল তা কাজ করতো না, ওদেরকে মেরে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করতো। জানি না কেন অন্যদের মেরে ফেলতে ইচ্ছে করতো। অনেক পরে বুঝেছি যে ওদের নাম ছিল, ঠিকানা ছিল। আমার ছিল না, তাইই বোধহয়।
মা উধাও হয়ে যাওয়ার পর পাড়ার এক প্রতিপত্তিশালী মুরুব্বী আমায় কাছে ডাকলেন।
‘তর মা’ডা তো গেল গা। কত্ত বালা আসিল তর মা; তুই এহানে থাকলেও থাকবার পারস, তর বইনেরে তর খালায় দ্যাকবো, চিন্তা করিস না। তুই থাক; যেই কামে আসিলি হেই করবার থাক। আর আমি তো আসিই; তরে দেইহা রাখুম।‘
আমি থাকিনি। বেরিয়ে যাওয়ার আগে, বোনের কাছে গিয়ে তাকে বুকে ধরে আদর করে, বেরিয়েছিলাম। এখন মনে হয় ওকে সাথে নিয়ে বেরোলেই বোধহয় ভাল হত। কিন্তু কিইই বা করতে পারতাম? ওকে কোথায় রাখতাম? তার চেয়ে, ওর থাকা-খাওয়ার একটা জায়গা তো ছিল। থাক ও।
কাজ পেতে অসুবিধে হয়নি। এ শহরে কাজের অভাব নেই। চারিদিকে কাজ। কোন কাজটি করবো তা ভাববার বিষয়। পরদিনই টেম্পো-হেল্পার হিসেবে এক কাজ পেয়ে গেলাম। খুশি। আর পান-মদ যোগান দিতে হবে না। ওগুলো যোগান দিয়ে কোন পয়সাও’তো পেতাম না। এ কাজে টাকা পাচ্ছিলাম। কাজ তেমন না। টেম্পো ছাড়ার আগে ট্যাঁ-ট্যাঁ করে যাত্রীদেরকে ডাকা, টেম্পোর পেছনে পা’দানিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর-পর টিনের ওপর থাবা দিয়ে শব্দ করা, যাত্রী বহন করা, স্ট্যান্ডে পৌঁছুলে মাটিতে নেমে যাত্রীদের কাপড় ধরে টেনে নামানো, নতুন যাত্রীর পাছায় ঠেলা দিয়ে টেম্পোতে উঠিয়ে দেয়া। পুরুষের পাছায় হাত দিয়ে আনন্দ পেতাম না। নারীতে পেতাম। জানি না কেন। অদ্ভুত আনন্দ। রক্ত নেচে উঠতো। এ আনন্দ কোথা থেকে আসতো তখন আমার জানা ছিল না।
চার বছর পেরিয়ে যায়। পা’দানিতেই দাঁড়িয়েই জীবন চলে। দিনে কামাই, রাতে খরচ, গভীর রাতে ঘুম, আবার ভোরে পা’দানিতে।
জানতে চাইলেন না আমি কত টাকা কামাই করতাম? রাতে কেমন করে খরচ করতাম। কামাইএর কথা নাই বা বলি; খুব সামান্য। আমি যেখানে রাত-যাপন করতাম সেখানে অনেক নামহীন মানুষ ঘুরে বেড়াতো। তাদের নামহীনতার সাথে আমার নামহীনতা লেপটে দিতাম। তারপর মায়া হত। দিনের কামাইগুলো ওদেরকে দিয়ে দিতাম।
একদিন পা’দানিতে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি এক ‘লোক’ আমার আমায় দেখছে। স্থির চোখে। দেখছে তো দেখছেই। আমার কেমন যেন লাগে। এর আগে আমার দিকে এমন করে কেউ তাকায়নি। মনে মনে বলি, এই লোকের পাছায় কি আমি চাপ দিয়েছিলাম? মনে করতে পারি না। লোকটা মুচকি-মুচকি হাসছিলও।
কয়েকটি ষ্ট্যান্ড পরেই সে নামে। সেই মুচকি হাসি। আমার গায়ে চাপ দেয়। বলে, ‘অই, কাম আসে; করবি’নি?’
চিরকূট ধরিয়ে দেয়। ‘ফোন করিস; আহিস্, কথা কমুনে; কাম আসে’।
ভাবতে-ভাবতে ক’দিন যায়। আসলে ভাবি না। ভাবার ভান করি। দোকানে গিয়ে ফোন করি। কি বলবো বুঝি না। সে তো তার নাম বলেনি। ‘স্যার’ বলে হ্যালো বলি। ‘আমি ওই টেম্পোর হেল্পার; চিনসেন? কাম আসে কইসিলেন; ফোন করতে কইসিলেন।‘
‘আসে-আসে। তুই বালা আসস্? বালা করসস্ ফোন দিয়া। তরে খুব পসন্দ হইসে’রে। খুব বালা পোলা তুই। তরে কাম দিমু।‘
‘সার, কি কাম করতে অইবো কইলেন না তো; কই আমু আপনের লগে বইতে? ঠিকানা দ্যান্; আয়া পরুম।‘
‘তর আইতে অইবো না; আমি তর লগে দেখা করুম; আমি যানি তুই কই থাকস্; দুই-একদিনের মইদ্দেই দেকা অইবো।‘
দেখা হয়ে গেল। সেদিন ভাল করে দেখেছিলাম। সাধারণ একটা মানুষ; শান্ত-শিষ্ট; সাধারণ কাপড়-চোপড়; দেখে অন্য মানুষকে কাজ দেয়ার মত মানুষ মনে হয়নি। চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে হাঁটতে বেরোলাম। তার নাম আমায় বলেনি। সিগারেট ধরিয়ে বলে – ‘প্রেম করতে পারবি? তর কাম অইবো প্রেম করা। ওইযে ফেসবুক না কি য্যেন্ কয়; অইহানে, মাইয়াগো লগে প্রেম করবি। তুইকি চিনস্ ফেসবুক? ইন্টারনেট বুজস্? কামাই করতে অইলে এগুলা চিনতে অইবো, বুচ্ছস্? কি, কামাই কি চাস্, না চাস্ না? কতা কস্ না ক্যান?’
‘চাই’।
‘তাইলে নে এই টাকাডা রাক; তরে সাদ দিন দিলাম। ইন্টারনেট সিক আর ফেসবুক সিক। মনে রাখিস, তুই কিন্তু এখন আম্গো কোম্পানির মানুস। যাহ, কতা কমুনে। আর অই বস্তি সাইড়া মেসে উড। এই কাম বস্তি থাইক্কা অয় না। মনে রাখিস, তুই কিন্তু আম্গো।‘
পাক্কা কুড়ি হাজার! মায়ের কথা মনে পড়ে। মা’কে মাঝে-মাঝে দেখেছি টাকা গুনতে। তখন টাকার অর্থ বুঝিনি। মা যে ওই টাকা খুব ভালবাসতো তা মনে হয়নি। তবে গুনে রাখতো। কিন্তু আমার টাকার চেহারা ভাল লেগে যায়। নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকি। অসাধারণ। টাকার প্রেমেই পড়ে যাই। কিন্তু প্রেম করার কাজটি নিয়ে তখনও এতোটা ভাবিনি। টাকা পেয়েই মনে হয়েছিল সব কাজই পারবো। তাকে দেয়া কথামত হেল্পারগিরী ছেড়ে দিয়ে এক মেসে উঠে জানিয়ে দিলাম। সে খুশি। দু’হাজার টাকায় একটা ফোন ও কিছু জামা-কাপড় কিনতে বললো। তাও করলাম। একদিন দেখা করতে চাইলো। দেখা হলো রাতে। নির্জন রাস্তায়। প্রথমে ইন্টারনেট ও তারপর ফেসবুক। বেশ অনেক কথা বললো। মোটামুটি বুঝলাম।
‘কাইল’ই ফেসবুকে একখান একাউন্ট খুলিস্। যা বুজাইলাম, হুইনা পারবি তো? তর পাড়ায় একখান সাইবারকাফে দেখসি। খুঁইজ্জা দেহিস, আরো আসে। একাউন্ট খুইল্লা আমারে জানাইস্।‘
আরো কথা হয়। সে আমায় প্রেম-ব্যবসা শেখায়, বোঝায়।
‘হুন, ফেসবুকে দেখবি অনেক সুন্দর-সুন্দর মাইয়া আসে। ওগো লগে ভাব করবি। কথা কবি; কথা হুনবি; গল্প করবি; প্রেম-ভালবাসা করবি; ভজাইবি; তাড়াহুড়া করবি না; ধীরে-ধীরে। নাইলে কিন্তু প্রেমে ফালাইতে পারবি না। মাইয়াগো মন খুব নরম; নরম কতা কইলেই ভইজ্জা যায়। তোর কাজ অইলো ভজানো। ফেসবুকের বাইরেও ফোনে কতা কবি। হিসাব রাকতে অইবো, কইলাম। নাইলে বিপদ আসে। গিফট পাঠাবি। হেরা খুশি অইবো। প্রেম জমলে, একদিন দেখা করতে চাবি। তুই রেডী অইলে একখান মোটরসাইকেল দিমু। আহারে, তরে লইয়া আমগো যে কত কাম! একদিন দেখা করবি। ডেটিং। ফেসবুকে যা, ডেটিং কারে কয় বুইজ্জা যাইবি। যায়গা কইয়া দিমু, মোটর চালান সিক, হালা; মোটরের পিসে বওয়াইয়া, ডেটিং’এ যাবি। গল্প করবি, নজরে নজর লাগাবি। কইসি না যায়গা দেখাইয়া দিমু। মাইয়াডারে ফালাইয়া থুইয়া মোটর চালাইয়া ফিরা আবি। এইডাই তর কাম। বুচ্ছস্? মাসে-মাসে একটা মাইয়া পাইলে বালা।’
‘মাইয়াডার কি অইবো?’
‘হেইডা চিন্তা কইরা তর কাম নাই; আমরা দেখুম। তুই ফালাইয়া আইবি, টাকা পাইবি। বাস; শ্যাষ। তর কাম ঐডাই; এ্যার বেশি না। খুশি? বালা, যা গুমা গিয়া। আর হুন, কেউ য্যেন্ না জানে; কাউরে জানাইলে, জানে মাইরা ফালামু। তুই এহন আম্গো কোম্পানির লোক।‘
আমি বুঝেছিলাম ব্যবসাটা আসলে কি। নামহীনতার ব্যবসা। মেয়েগুলো নামহীন হয়ে যাবে। পৃথিবী তাদের আর কোথাও খুঁজে পাবে না। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যাই, করবো না এ কাজ। পরদিনই কাজ শুরু হয়, আমার সামনে এক নতুন দুনিয়া উন্মোচিত হয়। ফেসবুকে এতো রঙ, এতো মানুষ, এতো কথা! ফেসবুকে বিচরণ করা মেয়েদের নিয়ে গবেষণা করি, ওদের প্রেমে বাঁধতে হবে, দু’একজনের সাথে টুকটাক কথা বলি, মন বোঝার চেষ্টা করি। অনেকেই নিজের ছবি দেয় না। অনেকের মনে অনেক কষ্ট। তাদের মনের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি। কেউ কেউ মন দিয়েও দেয়। এতো সহজ মেয়েদের মনে নেয়া! ঠিকই বলেছিল কোম্পানি, মেয়েদের মন নরম। মিষ্টি-মিষ্টি কথায় সহজেই প্রেমে পড়ে যায়। আমি সজাগ থাকি। আমি যেন কাউকে যেন ভালবেসে না ফেলি। একমাসের ভেতরেই একজন আমার সাথে বেড়াতে যেতে চায়।
কথামত মোটরসাইকেল আসে। আগেই চালানো শিখেছিলাম। হেল্পারগিরীর সময় অনেক কিছুই শেখা হয়েছে। মেয়েটির নামটি ছিল খুব সুন্দর, সাগরের নামে নাম। নাই বা বলি। নামহীন হয়েই থাক। ফেসবুকে অনেক নামঃ কষ্টের সাগর, ভোরের রদ্দুর, পড়ন্ত বিকেল, মেঘ বালিকা – কত। আমার নিজের নামও ছিল ‘মনের পাখি’, তবে আলাপকালে বলার জন্যে একটা নাম ছিল।
প্রথম যেদিন একজনকে নিয়ে বেড়াতে বেরোই, পরিপাটি হয়ে ফুলের দোকানে যাই, সুন্দর একটি হালকা বেগুনি রঙের ওড়না কিনি। মেয়েটিকে বলেছিলাম বেগুনী রঙের জামা পড়তে। দেখা হয়, একরাশ হাসি। আনন্দ দেখে মন জুড়িয়ে যায়। মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যাই শহরের বাইরে। উত্তর দিকে, কুড়ি কিলোমিটার দূরে, এক বন আছে, মানুষ ঢোকে না। কিছুটা মটর নিয়ে ঢুকে, গাছের আড়ালে রেখে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাই, কিছুদূর গিয়ে দু’জনে বসি। মেয়েটি প্রেমে বুঁদ হয়ে আছে। এমন মেয়ের সাথে যা ইচ্ছে করা যায়। আদর করি, কাছে টেনে নেই, চুমু খাই, অপলোক তাকিয়ে থাকি। সবই অভিনয়। প্রায় আধঘন্টা পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ভান করে একটু দূরে চলে যাই। জানি কি ঘটবে। মৃদু একটা চিৎকার শুনি। তারপর আর জানি না মেয়েটির জীবনে কি হয়। সন্তর্পনে বেরিয়ে আসি বন থেকে। ফিরে যাই শহরে।
কয়েকদিন ঘুম হয় না। মদ খেয়ে ঘুমাই। তবে আমার প্রেম-ব্যবসা চলতে থাকে। দিন যায়, মাস কাটে, বছরও পেরিয়ে বছরে গড়ায়। তিন বছর পেরিয়ে যায়, আমার প্রেমের ডালি ফুলে ফেঁপে ওঠে। আমি তখন কোম্পানির কাছে খুব প্রিয়। যা চাই, তাইই দেয়। আমার হাত দিয়ে একুশজন মেয়ে নামহীন হয়ে যায়। পদ্ধতি একই। বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসা। এ ব্যবসায়, অবস্থান বদলাতে হয়, এক বাসায় বেশিদিন থাকা যায় না, বেশি মানুষের সাথে মেশাও যায় না। আমি তাইই করতাম – মেস বদলাতাম, পাড়া বদলে চলে যেতাম অন্য পাড়ায়।
যেদিন বাইশতম মেয়েটিকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল, সেদিন সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি। এমন দিনে যাত্রা কষ্টকর হয়। কাজ সহজ হয় না। মেয়টির নাছোড়, কোম্পানিও বললো সেদিনই যেতে হবে, তারা কথা দিয়ে ফেলেছে। ভিজতে ভিজতে এক হাসপাতালের সামনে থেকে বাইশতম প্রেমিকাকে তুলে নেয়ার জন্যে মোটর থামাই। এই মেয়েটির চেহারা চিনতাম না, ফেসবুকে ছিল একটি ফুলের ছবি। ফোন কথা বলে চিনে নিতে হল।
স্তব্ধ হয়ে গেলাম দু’জনেই। মনে হল মাটি ফুঁড়ে নীচে তলিয়ে যাচ্ছি, মেয়েটি ফুটপাতের ওপর বসে পড়লো। আমি এতোদিন এই মেয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় করেছি! আমারই মায়ের পেটের সেই নামহীন ছোটবোন!
লজ্জায় মুখ তুলতে পারে না। এ লজ্জা আমিই বা রাখি কোথায়? পাহাড়ের চুড়া যেমন নিস্তব্ধ, তেমনই।
‘কোথায় থাকিস?’ কোনমতে জানতে চাই।
‘বস্তিতে’।
‘কি করিস?’
‘গার্মেন্টসের কাম’।
‘যা বাড়ি যা।‘
কোন মতে ডেরায় ফিরি।
নেশাগ্রস্তের মত হা করে তাকিয়ে থাকি দিন-রাত, ভাবনাহীন। ভাবলেই নিজের অমানবিকতা ধিক্কার দিচ্ছে। পরদিন গভীর রাতে – রাত একটা হবে বোধহয় – কোম্পানির ফোন আসে বাড়ির বাইরে আসতে। কথা আছে। তখন আশেপাশে কেউ নেই। বেরোতেই চড়াও হয় সাত-আটজন, সবার হাতে গাছের ডাল, মুখে গামছা। অনবরত মারতে থাকে। রাজ্যের হিংস্রতা তাদের শরীরে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে, একটা একটা করে হাড় ভাঙ্গার শব্দ পাই, মাংস থেতলে যাচ্ছে, হাড্ডির সাথে মিশে যাচ্ছে, মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করার কথা একবার মনে আসে, আর প্রয়োজন বোধ করি না, জ্ঞান হারানোর আগে আগে মায়ের চেহারাটা মনের চোখে ক্ষণিকের জন্য ভেসে ওঠে, দু’হাত বাড়িয়ে রয়েছে।
+++
প্রথম প্রকাশঃ শালুক
এটি সম্পাদনার আগের সংস্করণ

One Reply to “নামহীনতায়”

  1. বন্ধু, অসাধারণ! এক দমেই পড়ে ফেল্লাম। অল্প অল্প শব্দমালা। নতুন ঢং এ বাক্য বিন্যাস। সবটা মিলিয়ে একটা ঝরনা হিমালয় থেকে নামলো যেন। এলোমেলো চড়াই উতড়াই পেরিয়ে যখন মোহনায়। থিতু হয়ে পড়লো গল্পের আসর।
    নতুন আংগিকে গদ্য কথন। ভাললাগলো। লিখে যাও বন্ধু। শুভকামনা রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *