
মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না
সে কাঁদে। কাঁদতে-কাঁদতে, ডান হাতের আঙুলগুলোর পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমার আপিসঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। আমি আমার বসার টেবিল-চেয়ার থেকে উঠে এসে তার সাথে কথা বলার জন্য পাশেই রাখা সোফায় বসে কথা শুনি। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করি। সেও অপর দিকে রাখা আর এক সোফায় বসা।
এতক্ষণ তার লেবাসের দিকে আমার নজরে পড়েনি। কথাগুলো শোনাই মুখ্য ছিল। প্রায় আধঘণ্টা শুনেছি। বলেছিও। মাঝে মাঝে। আসলে প্রশ্ন করেছি। সে উত্তর দিয়েছে। ভরা গলায়। ক্ষণে ক্ষণেই কেঁদেছে। তবে উঠে চলে যাওয়ার সময় যেমন করে কাঁদল তা দেখে আমার মনে কিঞ্চিৎ সহানুভূতি জেগে উঠল। কান্না শুরু করতেই আমার দৃষ্টি কোনো এক অজানা আকর্ষণে আটকে গেল তার হালকা খয়েরি ওড়নায় আলতো করে ঢাকা বুকের দিকে। অলিম্পিকে মেয়েরা যখন সবার আগে ফিতে ছোঁয়ার জন্য আপ্রাণ দৌড়ায়, আমি তাদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাদের বুকের যেমন ওপর-নিচ উল্লম্ম্ফন দেখা যায়, তারও তেমনই। আমার মস্তিস্কে এক ভ্রমর ভোঁ-ভোঁ করে। ক্ষণিকের জন্য তার কান্না ভুলে যাই। মেয়েটির শরীরের নৈসর্গিক পার্থিবতার চিন্তা আমার মনে ভর করে। তার বুকজোড়ার কোনো তুলনা খুঁজে পাই না। তুলনা কেন খুঁজি তাও এমন মুহূর্তে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। দেখেও না দেখার ভান করা যায় না। কেউ যদি এমন শৈল্পিক বুকে ভুল করেও ছুঁয়ে দেওয়ার চিন্তা মাথায় আনে, তাকে সহসাই কোনো নরকে পাঠানোর কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন হতে পারে। এমন দৃশ্যে কখনও কখনও কোনো ব্রহ্মচারীর মনও উতলা হতে পারে।
যে মেয়েটির সাথে কথা বলেছি এতক্ষণ, তার একটি নাম দেওয়া প্রয়োজন। জহুরা হলে কেমন হয়? ঠিক। তার নাম দিই জহুরা। কিন্তু জহুরা কেন? এ নামটি কি একজন বিপদগ্রস্ত নারীর নামের সাথে মেলে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চাই না। আমার মনোনিবেশ এখন তার দিকে।
আলোচনা শেষ না হলেও তার কান্নায় আমি সভা সেখানেই থামাতে বাধ্য হই। তবে আমি চাইছিলাম আলোচনা চলুক। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে আমার পানে পেছন ফিরে দরজার দিকে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করতেই আমার দৃষ্টি গিয়ে বিঁধে জহুরার শরীরের পেছন প্রান্তে। হাঁটার গতিতে কিছুটা গড়মসি ভাব আছে। হয়তো যেতে চাইছে না। হয়তো ভাবছে কান্না দেখে আবার তাকে ডেকে বসাব। একবার তা মনেও হয়েছিল। তবে তার নিতম্বের আড়মোড়া দেখে সে চিন্তা বাদ দিতে হলো। এই মেয়ে বেশিক্ষণ আমার সামনে থাকলে আমার বুদ্ধিন্দ্রীয় ঝাপসা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাকে যেতে দিতে হবে।
তাছাড়া এ আলোচনায় আমি একা নই। সাথে আছেন আমাদের আপিসেরই আরও দু’জন কর্মী। দু’জনই আমাদের নারী সহকর্মী। অন্য বিভাগের। এদের মধ্যে একজন মেয়েটির বিভাগেরই। তিনজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে যা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছে। প্রথম যখন শুনি, মনে মনে বেশ হেসেছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই একটি কমিটি গঠিত হয় এ আপিসে- অনেক রকমের, অনেক নামের। অন্তত কুড়ি-পঁচিশটি কমিটি আছে আমাদের। বাহারি নাম। কালচারাল কমিটি, কস্ট-এফিশিয়েন্সি কমিটি, কেপিআই কমিটি, প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি, ফ্যাসিলিটিস কমিটি- আরও অনেক। নাম মনে রাখতেও বেশ বেগ পেতে হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কমিটি থেকে তাদের সভায় যোগদানের জন্য তলব করা হয়। না চাইলেও যেতে হয়, না হলে কেপিআই কমিটি বছর শেষে বোনাস দেবে না।
এমনই একটি কমিটি, ডিসিপিল্গন কমিটি। সেখান থেকে ডাক পড়েছে। কেউ মিটিংয়ে ডাকলে যোগ দিতেই হয়, না হলে নালিশ পৌঁছে যায়। কেউ না কেউ কান কথা চালান করে দেয়। তারপর হজম করতে হয় নানা বোমাবর্ষণ।
প্রথম সভা হয়েছে দু’দিন আগে। গিয়ে শুনি আমায় নতুন এক সাব-কমিটির চেয়ারপারসন করা হয়েছে। কমিটির কোনো নাম নেই। প্রশ্ন করে জানা গেল নাম ঠিক হয়নি, তবে এটাকে ‘স্পেশাল কমিটি’ বলে ডাকা হচ্ছে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে।
মেয়েটি জহুরা। ছেলেটিরও নাম দেবো। আরও পরে। কিছুক্ষণ পরেই।
ঘটনার শুরু দিন পাঁচেক আগে।
আপিসের একজন পরিচ্ছন্নকর্মী এই দু’জনকে আমাদের আপিসের তেরোতলার একটি ল্যাভাটরি থেকে একসাথে বেরোতে দেখেছে। ল্যাভাটরির অর্থ টয়লেট, শৌচাগার। একটি শৌচাগার যে এ আপিসে কতখানি অপরিচ্ছন্ন থাকতে পারে তা আমরা জানি। জহুরা এবং ছেলেটি আসলেই একসাথে সেখানে ঢুকেছিল কিনা, পরিচ্ছন্নকর্মী সত্য কথা বলছে কিনা তা বের করতে হবে। অনুসন্ধানের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে তাদের এ আপিসের চাকরিতে বহাল রাখা যাবে কিনা।
এ কেমন কথা? একজন পরিচ্ছন্নকর্মী বলেছে দু’জন মানুষকে সে একসাথে ল্যাভাটরির কোনো এক খোপ থেকে বেরোতে দেখেছে, অমনি একটি কমিটি বানিয়ে দু’জনকে লক্ষ্য করে এমন সব প্রশ্ন করতে হবে যেন তাদের দোষী হিসেবে প্রমাণ করা যায়!
ধরে নিলাম তারা ল্যাভাটরিতে আসলেই ঢুকেছিল নির্জনতার খোঁজে। নির্জনে একে অপরকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায়। সে কথাই সবাই ভাবছে। পরিচ্ছন্নকর্মী তেমনই আমাদের বলেছে। আমার মনে তখন অনেক রকমের প্রশ্নের আনাগোনা। ল্যাভাটরি ছাড়া আপিসে আরও অনেক নির্জন স্থান আছে। তারা সেখানে না গিয়ে গণমানুষ ব্যবহার করে এমন একটি স্থানে কেন ঢুকবে? আমার মনে হয়েছে ঘটনাটিতে কোথায় যেন একটি ফোকর আছে। তবে আমার কমিটির সদস্যদের অতি উদ্যত আড়ম্বর দেখে আমার একধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। তারা যেন মুখিয়ে আছেন এই ছেলেমেয়ে দু’জনকে কুপোকাত করার জন্য। দু’জনকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। তারা যখন প্রশ্ন করেছেন, দু’জনকে নিরুত্তর দেখে আরও খ্যাপাটে হয়ে প্রশ্নের বাণ ছুড়েছেন যেন দু’জন কাত হয়।
ছেলেটির সাথেও কথা হয়েছে। আমার এই আপিস ঘরেই। প্রশ্ন করেছি। অনেক। মুষড়ে পড়লেও ছেলেটি কাঁদেনি। ওর নাম দেওয়া যেতে পারে সমীর। শত প্রশ্নের উত্তরে সমীর বলেছে, ‘আমরা কিছু করিনি; আমরা নির্দোষ; আমার এ কথা আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে।’ এমন ব্যথিত চাউনি আমি জীবনে আর কারও চেহারায় দেখিনি। তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে এই ভেবেই সে অপমানিত।
বিশ্বাস করতে চেয়েছি। মেয়েটি যখন কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছে, আর ছেলেটি দিব্যি দিয়ে, হলফ করে বলছে তারা দোষহীন, আমার ভেতর গ্রিক দেবতা জিউসের মতো একজন জেগে ওঠে। মনে হয় আমি যেন সব দেখে ফেলেছি। মনে হয় চেয়ারপারসন হিসেবে যত ক্ষমতা আছে তা দিয়ে সহকর্মী দু’জনের প্রশ্নবাণ রুখে এদের মুক্ত করি।
কেন মুক্ত করতে চাই? জহুরাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার প্রবল এক ইচ্ছা আমার ভেতরে মাথাচাড়া দিয়েছে। তার শরীরের যে জ্যামিতিক সৌন্দর্য আমার মন কেড়েছে, তার সঙ্গে এ চিন্তার কোনো সম্পর্ক নেই। ছোটবেলা থেকেই নারীদের সব বিষয়েই সমর্থন করার এক আন্তরিক ইচ্ছা আমার সহজাত হয়ে আছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজেদের সংসারে নারীদের নানাভাবে অত্যাচারিত হতে দেখে তাদের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমার ভেতরে পুঞ্জীভূত হয়েছে। এমন কথা আসলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ব্যাপারটি সত্যিই তাই।
হয় না। মুক্ত করা যায় না। কেউ একজন তাদের দোষটি ঘটতে দেখেছে। সে একজন পরিচ্ছন্নকর্মীই হোক বা প্রধান নির্বাহী। আমাদের এই পরিচ্ছন্নকর্মীরও কিন্তু হাতে কোনো প্রমাণ নেই যে দু’জন সঙ্গম শেষে ল্যাভাটরি থেকে বেরিয়ে এসেছে। পরিচ্ছন্নকর্মীর কথাই আমাদের কাছে ‘প্রমাণ’। আমার কেন যেন মনে হয় পরিচ্ছন্নকর্মীর কথায় বা দেখায়, কোথায় যেন অধরা অসঙ্গতি আছে যা আমি ও আমার দুই সহকর্মী ঠাহর করতে পারছি না।
আপিসের এই তেরোতলার এক পাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়ার সময় একটি মোটামুটি চওড়া করিডোর পার হতে হয়। করিডোরের বাঁ পাশে সেই ল্যাভাটরিগুলো। পুরুষ ও নারীর জন্য আলাদা। পাঁচতারা হোটেলের মতো নয়। সাদামাটা। দুটো। দুটোই। করিডোর দিয়ে ওপাশে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে নাকে রুমাল চাপতে হয় বৈকি! তবে আমাদের সহ্য হয়ে গেছে। রুমাল না চাপলেও হয়। ডানপাশে বিশ্রামাগার। বিশ্রামাগারে প্রায়ই নানা রকম সভার আয়োজনও হয়। এমন গন্ধের মাঝে কেমন করে সভাগুলো হয় এখন তা নিয়ে আর কথা না বলি। আপিস তৈরির সময় মালিক পক্ষের কোনো একজনের মনে হয়েছিল কর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামাগারে বিশ্রাম নেবেন। তারপর আবার কাজ শুরু করবেন। অবশ্যই শুভ চিন্তা। তবে বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটে যখন ল্যাভাটরির বাতাস সেখানে পৌঁছে যায়। সে কারণেই কেউ বোধহয় সেখানে বিশ্রাম নিতে চান না। ফাঁকাই থাকে। ছেলেমেয়েরা যারা একে অপরকে পছন্দ করে, নিভৃতে কথা বলতে চায়, তারাই বসে।
পুরো আপিস ক্যামেরাচ্ছন্ন। সিসিটিভি। শুধু এই করিডোরে ক্যামেরা নেই। ক্যামেরা ঝোলানো উচিত বলে আমাদের কর্তৃপক্ষ মনে করেনি। কেউ যদি ল্যাভাটরিতে ঢুকেও থাকে, তা দেখার উপায় নেই, প্রমাণেরও উপায় নেই। পৃথিবীর সব কর্তৃপক্ষের মতো আমাদের কর্তৃপক্ষও তাই করেছে। সিসিটিভির ব্যবহার তো আমরা নিজেরা আবিস্কার করিনি! বিদেশে গিয়ে, দেখে শিখে এসেছি। শুধু দেখেই। ওদের স্থাপত্যশৈলী দেখেই আমরা শিখেছি। যাই হোক, স্থাপত্যের গল্প আরেকদিন শোনাব। এখন জহুরার কথা বলি।
তার জীবনে সমূহ বিপদ। বিপদটি সামাজিক। এ’দেশের মেয়েদের জীবনে বিপদ সব সময় সামাজিক প্রান্তর থেকেই আসে। তার বিরুদ্ধে আনা এ অভিযোগের প্রমাণ মিললেই চাকরিটা চলে যাবে; জনসমক্ষে রটে যাবে সে কেমন মেয়ে; আড্ডালোচনার ঝড় বইবে কিছুদিন। তারপর সবাই ভুলে যাবে ঠিকই, তবে মানুষটির যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যাবে।
জহুরা এ কথা আমায় বেশ কয়েকবার ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছে। বলেছে তাকে নিয়ে এমন রটনা রটে গেলে তার আর বিয়ে হবে না। তার বাবা নেই। ছোট্টকালে চলে গেছেন। মা কেমন করে তাকে এত বড় করেছেন তা সে নিজেও জানে না। মা এখন কিছু করতে পারেন না। পক্ষাঘাতগ্রস্ত। জহুরার এই চাকরিটাই সম্বল। কোনোমতে সেই চালিয়ে নিয়ে চলেছে। ফকিরেরপুলের এক কলোনিতে একটি ঘর সাবলেট নিয়ে থাকে। এ কথাও আমায় বলেছে। অনুনয় করে বলেছে, সে এমন কর্ম করেনি। এমন একজন মানুষকে চাকরিচ্যুত করার নিয়ামক আমি হতে চাই না। আমার ভেতরে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার এক প্রবল ইচ্ছা কাজ করছে।
সিসিটিভির সব চিত্র জোগাড় হয়। ‘স্পেশাল কমিটি’র তিনজনই দেখি। অনেক সকালের চিত্র। যখন আপিস খালি, শুধু পরিচ্ছন্নকর্মীরা ধোয়ামোছা করে। জহুরা আগে করিডোরে ঢুকেছে। তার কয়েক মিনিট পর সমীর। তারও প্রায় আধঘণ্টা পর পরিচ্ছন্নকর্মী। পরিচ্ছন্নকর্মী ঢোকার দু’মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এলো। তার পরপরই জহুরা। সমীর করিডোর দিয়ে বের হয়েছে অনেক পরে। তার কাছ থেকে শুনেছি সে বিশ্রামাগারে বসে ছিল। ক্যামেরায় ধরা আসা-যাওয়ার চিত্র কিছু প্রমাণ করে না। পরিচ্ছন্নকর্মীর কথাও কিছু প্রমাণ করে না।
সমীরের সাথে কথায় জানা গেছে, তারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করে ঠিকই এবং একাকী কথা বলার জন্যই সাতসকালে আপিসে এসেছিল, বিশ্রামাগারে বসে থেকেছে, কথা বলেছে, একজন আরেকজনের দিকে মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থেকেছে। তবে অতদূর? নাহ, ওই পর্যন্ত যায়নি। পরিচ্ছন্নকর্মী সেখানে ঢুকলে জহুরা বেরিয়ে এসেছে। সমীর বসেই ছিল। আমার দুই সহকর্মীর বাক্যবাণেও কিছু প্রমাণ হয় না। আমার নেতৃত্বে আমরা প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি যে, তারা নির্দোষ। হয়তো নয়, তবে আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। আমার শান্তি লাগছে। জহুরার শরীরের কারুকাজ মন থেকে দূর করতে না পারলেও একজন নারীকে বাঁচিয়ে দিতে পেরে খুশি। এদিকে আপিসে রৈরৈ পড়ে গেছে। জহুরা ঠিকই বলেছিল; এই রৈরৈ আরও অনেকদূর পৌঁছুবে; সমাজে ছড়িয়ে যাবে। তবে আজ আমার ভালো লাগছে। ওদের দু’জনের সাথে আজ আমরা শেষবার বসব। ঘোষণা দেব যে, ওরা নির্দোষ। প্রমাণ-সাপেক্ষে ওদের নির্দোষ বলে ঘোষণা দেওয়ার মতো অনেক যুক্তি আমি ডায়েরিতে টুকে রেখেছি। একটি উপসংহারও লিখে রেখেছি। ঘোষণা আমিই দেব। আজ সবার রৈরৈর মুখে ছাই দেব।
আপিসে এসেছি ঠিক ৯টায়। আগের রাতের ইমেইলগুলো সেরে ঘড়িতে দেখি সাড়ে ১০টা। ওদের সাথে দেখা হবে ১১টায়। এখানেই। জহুরাকে দেখেছি তার কিউবিকলে গিয়ে বসতে। মনে মনে বলেছি, ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো মেয়ে; তোমায় মুক্ত করে দেব।’ সমীরকে চোখে পড়েনি। হয়তো বারো কি চৌদ্দ তলায় গিয়েছে কাজে। হঠাৎ খিদে পায়। আপিস-অ্যাসিস্ট্যান্ট রফিককে ডেকে বলি চা-শিঙাড়া দিতে। সে চলে যায় তা আনতে। টেলিফোন বাজে। ধরি না। ল্যাভাটরিতে যেতে হবে। ফিরে এসে বসি। আবার টেলিফোন। এবার ধরি। মানবসম্পদ বিভাগের কাওসার।
‘স্যার, সমীর রেজিগনেশান লেটার পাঠিয়েছে।’
‘কার কাছে?’
‘মানবসম্পদ প্রধানের কাছে, স্যার।’
‘আচ্ছা, আমি দেখছি।’
মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে সমীরকে ফোন করি। বন্ধ। কয়েকবার ফোন করি। আসলেই বন্ধ। ফোন কানে রেখেই মনে মনে বলি- ‘সমীর, তুমি রণে ভঙ্গ দিলে আমি জহুরাকে বাঁচাব কেমন করে?!’