
সাহিত্যই হোক পাথেয়
ইংরেজ লেখক ফ্র্যান্সিস বেকন সতেরো’শ শতাব্দিতে বলেছিলেন ‘পড়াশোনা একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে, আলাপচারিতা তৈরী করে উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এবং লেখা একজন সঠিক মানুষ গড়ে’। তাঁর এই মূল্যবান কথাগুলো যখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো, দেশে-দেশে কবি-সাহিত্যিকদের মানস আরো উদ্ভাসিত হলো। রেনেসাঁর পর সারা বিশ্বের সাহিত্যিকদের চিন্তা-সাগরে আরেকটি মাত্রা যোগ হলো। যদিও সাহিত্যিকরা কারো জন্যে অপেক্ষা করেন না, কারণ সাহিত্যরচনা এমন একটি শিল্প যা নিজের তাগিদে, নিজের ভেতরে জন্ম নিয়ে বাড়তে থাকে এবং এক সময় একটি মহীরুহতে রূপ নেয়। পাঠকরা এই মহীরুহ থেকেই নিযা©স গ্রহণ করে নিজদের একটি সামগ্রিক ভূবন রচনা করেন।
এখানেই সাহিত্যিকদের সার্থকতা – তাঁরা সমাজের মানস তৈরীতে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন। আমরা যদি প্রাচীন গ্রীক, রোমান, আরব, আফ্রিকান ও সংস্কৃত সাহিত্যের দিকে তাকাই, সেখানেও দেখি লেখকরা কত বড় ভূমিকা রেখেছেন সমাজ পরিবর্তনে। লেখকরা সমাজের সামগ্রিক অন্তঃর্দৃষ্টি। সাধারণ মানুষ যা দেখে না বা যে বিষয় নিয়ে ভাবে না, সাহিত্যিকরা আমাদের তা মনে করিয়ে দেন। তা তাঁদের গল্পের মাধ্যমেই হোক আর কবিতা-নাটকের মাধ্যমেই হোক।
সংস্কৃত থেকে যখন বাংলা ভাষার উদ্ভব হলো, এ ভাষায় সাহিত্য আরও গৌরবান্নিত হলো। সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি পৌঁছুতে পারলো। আমাদের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্ধ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধূসদন দত্ত – সবাই আমাদের বাংলা জাতিসত্বা গড়ে দিয়েছেন। তাঁদের ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের ভাষা আমাদের সাহিত্য বিশ্বে একটি মযা©দার আসনে বসেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের ভাষা সৈনিক ও কবি-সাহিত্যিকদের অবদান ভোলার নয়। তাঁদের রচনাই আমাদের মনে স্বাধীনতার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল। তাঁদের লেখনীর জোরেই আমরা একবুক সাহস নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি। বর্তমানে আমাদের দেশ মাথা উঁচু করে পথ চলছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে সাহিত্যরচনা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শামসুর রহমান, সুফিয়া কামাল, রিজিয়া রহমান, আবুল হোসেন ও নির্মলেন্দু গুণের মত আরও অনেক সাহিত্যিক। এঁরা শুধু সাহিত্যিকই নন, এঁরা একেকজন চিন্তা-বিজ্ঞানী। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এঁদের লেখনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে আমাদের সমাজ এক ধাপ করে এগিয়ে গেছে। আমরা এঁদের চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত হয়েছি।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করার সময় আমাদের ভেতরে এমন চিন্তাই কাজ করেছিল। অর্থনীতির উন্নতির মাধ্যমে যেমন রাষ্ট্রের দক্ষতা বোঝা যায়, সাহিত্যের সমৃদ্ধির মাধ্যমের তেমনই বোঝা যায় একটি জাতির পরিণত মননশীলতা। আমরা বাংলাদেশের লেখকদের উৎসাহ দিতে চেয়েছি। আমরা চেয়েছি তাঁরা যেন তাঁদের লেখনী যেন আরও প্রগাঢ়তা নিয়ে সমাজে ছড়িয়ে যায়, এবং তাঁরা যেন আরও বেশি সাহিত্যরচনায় মনোনিবেশ করতে পারেন। একই সাথে আমরা সমাজে সাহিত্যপাঠের অভ্যাস বাড়ানোর কথাও চিন্তা করেছি। আমাদের সন্তানরা যেন বই পড়তে উৎসাহিত হয়, সেটিও আমরা একটি প্রধান বিষয় বলে গণ্য করেছি।
এই পুরস্কার যেমন দেশের প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ লেখকরা পেয়েছেন, তেমন অনেক তরুণ লেখকও এই পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করে সাহিত্যাঙ্গনে এগিয়ে গেছেন। আমরা জানি সাহিত্যিকরা পুরস্কার পাওয়ার জন্য সাহিত্যরচনা করেন না। তাঁরা নিরন্তর লিখে যান তাঁদের প্রাণের তাগিদেই। এই শিল্পটিই হচ্ছে প্রাণের শিল্প, মনের শিল্প। তবে একটি পুরস্কার লেখার আগ্রহ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি তাইই ঘটেছে। যাঁরা বিগত বছরগুলোতে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের লেখনী আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের সৃষ্টকম© আরও বেশি পাঠক পড়েছেন, এবং তাঁদের লেখা এখন আমাদের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বে।
আমাদের খুব ভাল লাগছে যে ২০১৮ সালের পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন নারী লেখক। সেলিনা হোসেন, সনজীদা খাতুন এবং স্বরলিপির এই স্বার্থকতা আমাদের অন্যান্য নারী লেখকদের অনুপ্রেরণা দেবে।
এই সাহিত্য পুরস্কারটি নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের এক ধরণের গব© আছে। এ’টি লেখক সমাজে ইতিমধ্যে যে সাড়া এবং উদ্দীপণার জন্ম দিয়েছে, তা দেখে আমরা বুঝি যে এই পুরস্কার দেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মযা©দার একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। এবং সমকালের মত একটি সাহিত্যমনষ্ক ও অধ্যাবসায়ী সংবাদপত্রের সাথে কাজ করতে পারাও আরেকটি গবে©র বিষয়। সমকালকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আমাদেরকে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে কিছুটা আবদান রাখার সুযোগ দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ যে মানুষটির প্রাপ্য তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারোয়ার। তাঁর জন্য অতল শ্রদ্ধা। তাঁর দেখানো পথ ধরে আমরা এই পুরস্কারটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবো।